উহুদের যুদ্ধঃ সাহাবিদের রক্তরঞ্জিত এক যুদ্ধের ইতিহাস

বদরের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় হয়। এই যুদ্ধে আবু জাহেলসহ মক্কার অধিকাংশ প্রবীণ ব্যক্তি নিহত হন। এরই প্রতিশোধ নিতে তৃতীয় হিজরি সালে মক্কার কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্য নিয়ে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয়। তাদের প্রতিহত করতে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ১০০০ সৈন্যের একটি দল নিয়ে মদিনা থেকে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বিশ্বাসঘাতকতা করে ৩০০ সৈন্যসহ সরে দাঁড়ায়। ফলে মহানবী (সা.) মাত্র ৭০০ সৈন্য নিয়ে কুরাইশদের বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হন। তারা মদিনার নিকটবর্তী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির স্থাপন করেন।

যুদ্ধের আগে

২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে উভয় দল সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধ শুরুর আগে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.)-এর নেতৃত্বে ৫০ জন তীরন্দাজের একটি দলকে কানাত উপত্যকায় অবস্থিত একটি গিরিপথে প্রেরণ করেন। কারণ, কুরাইশরা যাতে মুসলিমদের পেছন থেকে হামলা করতে না পারে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) আদেশ দিয়েছিলেন—

“তোমরা শত্রুদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে তাদের আমাদের কাছ থেকে দূরে রাখবে। আমরা যদি জয়লাভ করি বা পরাজিত হই, তোমরা তোমাদের অবস্থানে অবিচল থাকবে। তোমরা যেখানে অবস্থান নিয়েছ, সেদিক থেকে যেন কোনো হামলা না আসে, তা লক্ষ্য রাখবে। আমাদের পেছনের দিক তোমাদের হেফাজতে থাকবে। যদি দেখো আমরা মারা পড়েছি, তবুও আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না; যদি দেখো আমরা গনীমতের মাল আহরণ করছি, তবুও অংশ নেবে না—যদি না আমি ডেকে না পাঠাই।”

সহীহ বোখারীতে উল্লেখিত হাদিস অনুযায়ী, তিনি বলেছিলেন—

“যদি তোমরা দেখো, আমাদেরকে পাখি ঠুকরাচ্ছে, তবুও নিজের জায়গা ছাড়বে না—যদি আমি ডেকে না পাঠাই। যদি তোমরা দেখো, আমরা শত্রুদের পরাজিত করছি এবং একসময়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি, তবুও নিজের জায়গা ছাড়বে না—যদি আমি ডেকে না পাঠাই।”

যুদ্ধের শুরু

কুরাইশদের পক্ষ হতে তালহা ইবনে আবু তালহা আবদারি দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য আহ্বান করেন। এরপর হযরত আলি (রা.) এগিয়ে এসে তাকে হত্যা করেন। এটি দেখে তালহার ভাই ওসমান এগিয়ে আসে, কিন্তু হযরত হামজা (রা.) তাকেও জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ, কিন্তু এবারও মুসলিমদের প্রথম ধাক্কাতেই কুরাইশরা পালাতে শুরু করে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে মনে করে গিরিপথে নিযুক্ত ৫০ জন তীরন্দাজের মধ্যে মাত্র ১২ জন ব্যতীত সবাই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদেশ অমান্য করে গনীমতের মাল আহরণে যায়।

এই সুযোগে খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে কিছু অশ্বারোহী মুসলিমদের পেছন থেকে হামলা চালায়। তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেই ১২ জন তীরন্দাজই শহীদ হন। এই অতর্কিত হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে মুসলিম বাহিনী। নেমে আসে প্রচণ্ড বিপর্যয়। হামলা এতটাই তীব্র ছিল যে অনেক মুসলিম সেনা পিছু হটতে বাধ্য হন। তখনও যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। এক কুরাইশ সেনা তাঁর দিকে পাথর নিক্ষেপ করলে তাঁর একটি দাঁত ভেঙে যায়। একাধিক আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৯ জন দেহরক্ষীর মধ্যে ৭ জন শহীদ হন। তিনি আহত অবস্থায় একটি গর্তে পড়ে যান। যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিহত হয়েছেন। এই ভুল সংবাদ তাঁর জীবনকে শত্রুর কবল থেকে আড়াল করে রাখে। কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফেরে। হযরত তালহা (রা.) গুরুতর আহত হলেও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পাহাড়ের উপর তুলে আনেন। অন্যান্য সাহাবারাও তাঁর সেবায় ছুটে আসেন।

এই দ্বিতীয় হামলায় জুবাইর ইবনে মুতইমের হাবশি ক্রীতদাস ওয়াহশির নিক্ষিপ্ত বর্শায় শহীদ হন হযরত হামজা (রা.)।

শহীদদের অঙ্গচ্ছেদন

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে এটি ছিল শত্রুদের সর্বশেষ হামলা। তারা নিশ্চিতভাবে জানত না, তিনি বেঁচে আছেন কিনা। ফলে তারা শিবিরে ফিরে গিয়ে মক্কায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ সময়ে কিছু মুশরিক নারী-পুরুষ শহীদদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হযরত হামজা (রা.)-এর বুক চিরে কলিজা বের করে চিবোতে থাকেন। গিলে ফেলতে না পেরে ফেলে দেন। এছাড়া কর্তিত নাক ও কান দিয়ে মালা গেঁথে গলায় ও পায়ে অলংকারের মতো পরে।

যুদ্ধ শেষে

যুদ্ধ শেষে দেখা যায়, উহুদের ময়দানে পড়ে আছে ৭০ জন সাহাবি। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল উহুদের ময়দান। হযরত হামজা (রা.)-সহ অনেক শহীদের দেহ ক্ষতবিক্ষত ছিল। তাঁদের সবাইকে উহুদের ময়দানেই সমাহিত করা হয়।