আমার হৃদয়ে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যুগশ্রেষ্ঠ এক দাঈ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত সাবেক নায়েবে আমীর। সাবেক সংসদ সদস্য। অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান। বহু গুণে ও যোগ্যতায় সমৃদ্ধ একজন মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশে তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের সূত্রপাতের ইতিহাসের সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে, আর তাঁর সুকণ্ঠী বয়ান দিয়েই তাফসীরুল কুরআনের এই আয়োজন আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে।

আল্লামা সাঈদী নিছক কোনো নাম বা পদবি নয়। বরং বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের একটি গৌরবজ্জল অধ্যায়। বাংলার আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সিলসিলা এবং রেখে যাওয়া অনন্যসাধারণ সব কর্মকাণ্ড যুগ যুগ ধরে অগণিত মানুষকে আলোর পথ দেখাবে, ইনশাআল্লাহ। তাকে শুধু মুসলিমরা নয়, অনেক অমুসলিমও তাকে ভালোবাসতেন।

দেশে ও বিদেশে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহী তো আছেনই, ভিন্নমতের ও ভিন্ন আদর্শের মানুষের কাছেও তাঁর জনপ্রিয়তা নজিরবিহীন। এমনকি তার প্রতিপক্ষও তার নানামুখী কর্মকাণ্ডের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এমনকি আল্লামা সাঈদীর ইন্তেকালের পর তৎকালীন সরকারি দলের নেতাকর্মীরা শোকবাণী দিয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করে দল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী শুধু একজন আলেমে দ্বীনই নয়, বরং অসংখ্য আলেমেরও ওস্তাদ ও পথ প্রদর্শক। জীবনের শেষ ১৩টি বছর আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড নির্যাতন ও বৈরিতার মুখেও তিনি কখনোই এই জালিমের সামনে আপস করেননি।

উৎকৃষ্ট শব্দচয়ন তার বক্তব্যকে করেছে সমৃদ্ধ। এত স্পষ্ট এবং এত প্রকাশ্য আলোচনা সহজে শোনা যায় না। এরকম বক্তাও পাওয়া খুবই কঠিন, যার বক্তব্য একইসাথে সমাজের আমজনতা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত পর্যন্ত সব শ্রেণিকে একইভাবে বিমোহিত করেছে।

তিনি যখন ওয়াজ শুরু করতেন, তখন দেখা যেত সামনের ময়দান তো বটেই, আশপাশের ভবনের বারান্দা, ছাদ থেকে এমনকি গাছের মগডালে বসে মানুষজন তাঁর ওয়াজ শ্রবণ করতো। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন বক্তা। সুদীর্ঘ ৫০টি বছর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়নে এবং দেশের বাইরের অগণিত স্থানে কুরআন নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, আলোচনা করেছেন।

কিন্তু তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ড, ইনশাআল্লাহ, আরো অনেক বছর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মুসলিমদের প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্পাদিত নেক আমলগুলো কবুল করুন। আজকের এই সংক্ষিপ্ত রচনায় আমি আল্লামা সাঈদীর জীবন ও কর্মের ওপর সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

জন্ম
শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পিরোজপুরের ইন্দুরকানীর বালিপাড়া ইউনিয়নের সাঈদখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম ইউসুফ সাঈদী একজন আলেম, শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারক ছিলেন। আর তাঁর মাতা মরহুমা গুলনাহার। তাঁর পিতা সম্মানিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।

শিক্ষা ও কর্ম জীবন
শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তার বাবার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তার প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ছারছিনা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ও পরবর্তীতে খুলনা আলিয়া মাদ্রাসায় স্থানান্তরিত হন। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের পর সাঈদী স্থানীয় গ্রামে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি মুসলমান আলেম বা মাওলানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি তাফসীর শাস্ত্রে কামিল পাশ করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি ইসলাম প্রচারের সাথে যুক্ত হন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করার পর তিনি দীর্ঘ ৫ বছর ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, মনোবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভাষার ওপর বিশ্লেষণধর্মী গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

পারিবারিক জীবন
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর স্ত্রীর নাম শেখ সালেহা বেগম। এই দম্পতীর চার সন্তান হলো— রফিক বিন সাঈদী (২০১২ সালে হৃদরোগে মারা যান), শামীম সাঈদী, মাসঊদ সাঈদী ও নাসিম সাঈদী।

রাজনৈতিক জীবন
সত্তরের দশকে শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাধারণ সমর্থক হিসেবে জামায়াতে যোগদান করেন। এরপর ১৯৭৯ সালে জামায়াতের রুকন, ১৯৮৯ সালে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য, ১৯৯৬ সালে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এবং ১৯৯৮ সালে তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য হন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে শাহাদাতের আগ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জামায়াত থেকে পিরোজপুর-১ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।

শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে ধারণ করার চেষ্টা করতেন। জামায়াতে ইসলামীর বেসিক শিক্ষাই এটি। ফলশ্রুতিতে তিনি এদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও যাতে ইসলামের বিধান অনুসারে হয়, সেজন্য চেষ্টা সাধনা করেছেন।

সংসদে স্পিকারের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে ঢোকার যে শিরকি রীতি ছিল, আল্লামা সাঈদীর প্রচেষ্টায় তা বন্ধ হয়েছিল। তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সদস্য ছিলেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যাকাত বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি বহু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।

দ্বিতীয় দফা এমপি থাকাকালীন সময়ে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ৮ম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে ২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে জাতীয় সংসদে ‘কওমী সনদের স্বীকৃতি’ এবং কওমী মাদরাসার সমন্বয়, উন্নয়ন ও পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের জন্য ‘কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ’ নামে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গঠনের বিষয়ে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করেছিলেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
ক. ১৯৭৬ সাল থেকে সৌদি আমন্ত্রণে রাজকীয় অতিথি হিসেবে তিনি হজ্জ ব্রত পালন করেন।
খ. ১৯৮২ সালে ইমাম খোমিনির আমন্ত্রণে ইরানের প্রথম বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপনের জন্য তিনি তেহরান সফর করেন।
গ. ১৯৯১ সালে সৌদি বাদশার আমন্ত্রণে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধের মিমাংসা বৈঠকে তিনি যোগদান করেন।
ঘ. ১৯৯১ সালে ইসলামী সার্কেল অফ নর্থ অ্যামেরিকা তাকে “আল্লামা” খেতাবে ভূষিত করে।
ঙ. ১৯৯৩ সালে নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সামনে আমেরিকান মুসলিম ডে প্যারেড সম্মেলনে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে “গ্র্যান্ড মার্শাল” পদক দেওয়া হয়।
চ. দুবাই সরকারের আমন্ত্রণে ২০০০ সালের ৮ই ডিসেম্বর আরব আমিরাতে ৫০,০০০-এরও বেশি শ্রোতার সামনে তিনি কোরআনের তাফসীর পেশ করেন।
ছ. লন্ডন মুসলিম সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাবা শরীফের সম্মানিত ইমাম শায়েখ আব্দুর রাহমান আস-সুদাইসের সাথে মাওলানা সাঈদীও আমন্ত্রিত হন।

আল্লামা সাঈদীকে হত্যা চেষ্টা
শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দাওয়াতী কর্মকাণ্ডে ভীত হয়ে মুশরিক ও সমাজতান্ত্রিক বামপন্থীরা তাঁর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করেছিল। চারবার তাঁকে সরাসরি হত্যার চেষ্টা করা হয়।

১. ১৯৭৩ সালের ১৪ জানুয়ারি: চাঁপাই নবাবগঞ্জে তাফসীর মাহফিল শেষে আল্লামা সাঈদীর থাকা বাড়িটি সন্ত্রাসীরা ঘিরে ফেলে। মাওলানা খোদা বখস খানের তৎপরতায় আল্লামা সাঈদী নিরাপদে রক্ষা পান।

২. ১৯৭৪ সালের ২৯ নভেম্বর: পাবনার পুষ্পপাড়া আলিয়া মাদরাসার মাহফিল শেষে ঘাতকেরা গুলি চালায়। মুহূর্তেই মাওলানা নুরুল্লাহ শাহাদাত বরণ করেন, আল্লামা সাঈদী প্রাণে বাঁচেন।

৩. ১৯৮৬ সালের ২১ অক্টোবর: চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মাহফিলে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা আল্লামা সাঈদীর গাড়ি আটকায়। একজন স্থানীয় কর্মকর্তা দ্রুত এসে গাড়িটিকে হেফাজতে নেন, ফলে আল্লামা সাঈদী বেঁচে যান।

৪. ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর: ঢাকার পান্থপথে মাহফিলের সময় সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। আল্লামা সাঈদী সাহসী অবস্থানে দাঁড়ান এবং লাখো জনতা জীবন ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাসীদের ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে।

সন্ত্রাসীরা ছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য। এই জঙ্গী সংগঠন ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। এই জঙ্গীরা সারা দেশে বহু ইসলামপন্থী মানুষকে খুন করে।

দাওয়াতী কাজ
১৯৬৭ সাল থেকে তিনি “দা’ঈ ইলাল্লাহ” হিসেবে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পৃথিবীর অর্ধশতেরও বেশি দেশে আমন্ত্রিত হয়ে ইসলামের সু-মহান আদর্শ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। মুসলিমদের তিনি কুরআনের অনুশাসন মানার জন্য আহ্বান করেছেন।
অমুসলিমদের তিনি ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করেছেন। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি জালিমের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার আহ্বান করেছেন। তাঁর দাওয়াতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সহস্রাধিক অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছেন।

ক. চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউন্ড ময়দানে প্রতি বছর ৫ দিন করে দীর্ঘ ২৯ বছর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র কাবা শরীফের সম্মানিত ইমাম এ মাহফিলে দু’বার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
খ. খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানসহ শহরের বিভিন্ন মাঠে প্রতি বছর ২ দিন করে দীর্ঘ ৩৮ বছর তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
গ. সিলেট সরকারী আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে প্রতি বছর ৩ দিন করে দীর্ঘ ৩৩ বছর যাবৎ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
ঘ. রাজশাহী সরকারী মাদ্রাসা মাঠে প্রতি বছর ৩ দিন করে দীর্ঘ ৩৫ বছর যাবৎ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় তিনি তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে দীর্ঘ অর্ধশত বছর কাজ করেছেন।

গ্রেপ্তার ও প্রহসনের রায়
কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে মাজার পুজারীদের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯শে জুন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গ্রেপ্তার হন। ওই বছরের ২১ জুলাই সাঈদীর বিরুদ্ধে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। ২ নভেম্বর তাঁকে কথিত ও সাজানো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করে।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা সাঈদীকে সাজানো মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে সারাদেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের এমন কোনো উপজেলা বাকী ছিল না যেখানে এই রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়নি। তাঁর ভালোবাসায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় বের হয়। যুবক, বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর এমনকি নারীরাও এই প্রহসনের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, অনেক এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ও আল্লামা সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।

মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর প্রায় দুই সপ্তাহ দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার জনগণের বুকে গুলি চালিয়ে আল্লামা সাঈদীর প্রতি মানুষের ভালোবাসার জবাব দেয়। সারাদেশে আড়াই শতাধিক মানুষকে খুন করা হয়। পুলিশের নির্বিচার গুলিতেও মানুষ অবিচল হয়ে দাঁড়ায়। একজন মানুষের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় এতো মানুষের জীবন দেওয়ার ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে বিরল।

এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ পৃথক দুটি আপিল হয়। একটি করেন আল্লামা সাঈদীর পক্ষ, আরেকটি করে সরকারপক্ষ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা ঘোষিত না হওয়া ছয় অভিযোগে শাস্তির আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ এবং ফাঁসির আদেশ থেকে আল্লামা সাঈদীর খালাস চেয়ে আপিল করে আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা।

আপিল শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আল্লামা সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। বিচারপতিদের মধ্যে মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে আল্লামা সাঈদীকে খালাস দেন। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী আসামির মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন। তবে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতামতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে।

শাহাদাত
২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট রবিবার সকালে বুকের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ. তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কাশিমপুর কারাগার থেকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে পিজি হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারা কর্তৃপক্ষের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসতে সারাদিন ব্যয় হয়। ১৩ তারিখ রাত ১১টার পর তাঁকে পিজি হাসপাতালে আনা হয়।

আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। প্রায় ৮৪ বছর বয়সী আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর হার্টে পাঁচটি রিং পরানো ছিল। এত সিরিয়াস রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালের পর থেকে শাহাদাত পর্যন্ত তাঁর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি।

১৩ আগস্ট রাত ১১টায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর থেকে পরিবারকে তাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। এমনকি তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার পরিবারের সাথে কাউন্সেলিং করা ও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ১৪ আগস্ট রাত ৯টায় পরিবারকে জানানো হয় তিনি ৮টা ৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন।

ইন্তেকালের পর প্রতিক্রিয়া
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ.-এর চিকিৎসা নিয়ে তাঁর পরিবার ও দেশবাসীর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। আল্লামা সাঈদীর বিপুল জনপ্রিয়তা ভীত হয়ে ১৪ আগস্ট ২০২৩ তারিখে তাঁর শাহাদাতের পর ঢাকায় জানাজা করতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার। তারা রাতের আঁধারে আল্লামা সাঈদীর লাশ পিরোজপুরে নিয়ে গিয়ে দাফন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাঈদী ভক্তদের প্রতিরোধে পুলিশ তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

আল্লামা সাঈদীর শাহাদাতের খবর শুনে মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ পিজি হাসপাতাল ও শাহবাগ এলাকায় জমায়েত হয়। তারা সারারাত আল্লামা সাঈদী মৃতদেহ পাহারা দেয়। ১৫ আগস্ট সকালে ফজর নামাজের পর পুলিশ পিজি হাসপাতালে তাণ্ডব চালায়।

কোনো যুদ্ধকবলিত এলাকায়ও যা হয়নি, পিজি হাসপাতালে সেই কাজটাই করেছে সরকার। তারা হাসপাতালে টিয়ার শেল, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। হাজার হাজার রোগী শ্বাসকষ্টে পড়েছিল। ফজরের পর মুহূর্তে গুলি করে তারা আল্লামা সাঈদীর লাশ ছিনিয়ে পিরোজপুরে নিয়ে যায়।

পিরোজপুরে আল্লামা সাঈদীর জন্মভূমিতে লাখ লাখ জনতা উপস্থিত ছিল। পুলিশ সেখানে দ্রুত দাফন করতে চেয়েছিল, কিন্তু জনগণ আল্লামা সাঈদীর ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য করে। অবশেষে পিরোজপুরে দুপুর ১টায় ১ম জানাজা ও দুপুর ২টায় ২য় জানাজা শেষে তাঁকে আল্লামা সাঈদীর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

লক্ষ লক্ষ মানুষকে কাঁদিয়ে নশ্বর দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেছেন আল্লামা সাঈদী। আল্লামা সাঈদী শুধু একজন আলেম ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিপ্লবী। তাঁর তাফসীরুল কুরআন মাহফিল শুধু মানুষের অন্তরে নয়, গোটা জগতে সাড়া ফেলেছিল।

মহান রাব্বুল আলামীন এই মহান দা’ঈকে কবুল করুন, তাঁকে জান্নাতে সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করুন। শুহাদা, সালেহিন, সিদ্দিকিন ও নবীগণের সাথে তাঁকে সম্মানিত করুন। আমিন।