যে আলৌকিত ঘটনায় ইসলামের ছায়াতলে আসে মালদ্বীপ

একসময় মালদ্বীপে মুসলমানদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তবে বর্তমানে সেখানে শতভাগ নাগরিক মুসলমান। তাহলে কিভাবে ইসলাম মালদ্বীপে পৌঁছাল এবং সেখানে কিভাবে ইসলামের আধিপত্য বিস্তার হল? কে সেখানে ইসলাম প্রচার করেছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে নিম্নোক্ত ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণবৃত্তান্তে ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে মালদ্বীপ ভ্রমণকালে লক্ষ্য করেন যে, সেখানকার সকল মানুষ মুসলমান। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সেখানে কোনো ইসলাম প্রচারক পৌঁছাননি। তাহলে তারা সবাই কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করল? জানতে চাইলে তিনি সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তখন তারা একটি অদ্ভুত ঘটনা বর্ণনা করে।

আরবের এক বাণিজ্যিক জাহাজ পূর্ব দিকে যাত্রা করছিল। কিন্তু জাহাজটি সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে এবং তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এতে জাহাজের সকল অভিযাত্রী মারা যান, তবে একজন কোনওভাবে ভেঙে যাওয়া জাহাজের কাঠখণ্ড আঁকড়ে ধরে মালদ্বীপে পৌঁছান। এই যুবক ছিলেন একজন আরব এবং হাফেজে কোরআন। তার নাম ছিল আবুল বারাকাত ইউসুফ আল-বারবারি আল-মাগরিবি। ভাসতে ভাসতে তিনি মালদ্বীপে এসে পৌঁছান এবং সেখানে এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেন।

আবুল বারাকাত তখন শৈশব পার করে যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন। তার মুখে তখনো দাড়ি-গোঁফ গজায়নি। তিনি বন থেকে কাঠ কেটে জীবনযাপন করতে শুরু করেন। একদিন বাড়ি ফিরে দেখেন, বৃদ্ধা ও তার মেয়ে কাঁদছেন। তিনি কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। তখন বৃদ্ধা বলেন, “আজ আমার মেয়ে মারা যাবে।”

‘আবুল বারাকাত’ জিজ্ঞাসা করেন, “কেন মারা যাবেন? তিনি তো সুস্থ আছেন।” বৃদ্ধা বলেন, “তুমি দেখো, মৃত্যু আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে।” বাড়ির সামনে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে।

তিনি জানতে চান, “তারা কি আপনার মেয়েকে হত্যা করবে?” বৃদ্ধা বলেন, “না, বিষয়টা এমন না। আমাদের দ্বীপে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে সামুদ্রিক বিপদ আসে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট তারিখে একজন তরুণীকে সূর্যাস্তের পর সমুদ্র উপকূলে মন্দিরে রেখে আসতে হয়। পরদিন সকালে রাজার সৈন্যরা সেই তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এবার আমার মেয়ে লটারিতে নির্বাচিত হয়েছে এবং তাকে ওই রাতেই মন্দিরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এতে তার মৃত্যু অনিবার্য।”

বৃদ্ধার বেদনাদায়ক কথা শুনে আবুল বারাকাত খুব বিচলিত হন। তিনি পরামর্শ দেন, “আপনার মেয়েকে পাঠানোর দরকার নেই। আমি নিজেই সেখানে যাব এবং প্রয়োজন হলে আমার জীবন দিব।”

আবুল বারাকাত বলেন, “আমি একজন মুসলমান। মুসলমান একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না। জীবন ও মৃত্যু শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে।”

বৃদ্ধা সেসময় রাজি হন। পরবর্তী সময়ে সৈন্যরা তাকে নিয়ে যায় এবং তাকে তরুণীর পোশাক পরিয়ে মন্দিরে রেখে আসে। সেখানে তিনি একাকী রাতের নামাজ আদায় করেন এবং কোরআন তিলাওয়াত করেন। রাতে সমুদ্রের ঢেউ উত্তাল হতে শুরু করে এবং এক বিরাট রাক্ষস মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু যখন রাক্ষসটি কোরআনের আয়াতের ধ্বনি শুনতে পায়, তখন সে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হতে না পেরে ফিরে যায়।

পরদিন সৈন্যরা মন্দিরে গিয়ে কোনো লাশ বা তরুণীকে না দেখে অবাক হয়। বরং তারা সেখানে একটি যুবককে দেখে, যিনি কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন। সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে রাজার কাছে নিয়ে যায়। রাজা তার কাছে ঘটনার বর্ণনা শুনে এবং বিষয়টি নিশ্চিত হতে মেয়েটিকে ডেকে আনেন। মেয়েটি ও তার মা রাজার কাছে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।

রাজার হৃদয় খুব প্রভাবিত হয়। তিনি যুবককে বলেন, “তুমি কীভাবে একা এই বিপদের মোকাবিলা করলে?” যুবক জবাব দেন, “আমার সঙ্গে ছিল আমার আল্লাহ। আমি একা ছিলাম না, আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন।”

এরপর রাজা যুবককে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি আবারও এই কাজ করতে পারবে কি না?” যুবক দৃঢ়ভাবে বলেন, “হ্যাঁ, যদি আল্লাহ চান।”

রাজার এই বিস্ময়কর ঘটনার পর, তিনি বলেন, “যদি তুমি এটি করতে পার, তাহলে আমরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করব।” পরবর্তী বছর একই ঘটনা ঘটে, এবং সেই যুবক আবারও দানবকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন।

এরপর রাজা এবং তার দরবারের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। মালদ্বীপের সবাই ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয় এবং প্রথম দিনেই প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার লোক মুসলমান হয়ে যায়। এরপর মালদ্বীপের অন্যান্য বাসিন্দারাও ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই ঘটনা ১১৪০ সালে ঘটেছিল এবং মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতার সফরনামায় এটির উল্লেখ রয়েছে।