বিদ্যা অর্জন করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অত্যাবশ্যক। সাংসারিক জীবনকে সুন্দর ও সুষম করে তুলতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন। এটা নারীকে দেওয়া কোনো সুযোগ-সুবিধা নয়—এটা নারীর অধিকার। নারীরা ভবিষ্যৎ মাতৃত্বের দায়িত্ব বহন করে। আজকের মানবশিশুই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। এই ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নারীদের উপরেই বর্তায়। নারী তথা মা-ই একজন সন্তানের প্রথম শিক্ষক। একজন শিশু নানা বিষয়ে প্রথমে মায়ের কাছ থেকেই শেখে। কিন্তু আজও বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নারী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে সন্তানের প্রথম শিক্ষকই থেকে যাচ্ছে শিক্ষার অন্তরালে। সন্তান শিক্ষিত না হলে স্বাভাবিকভাবেই জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
নারীশিক্ষার অতীত
আমাদের দেশের নারীশিক্ষার অতীত ইতিহাস খুবই ভয়াবহ। বাঙালি নারীরা গৃহকোণেই গড়ে তুলেছিল তাদের নিরাপদ আবাস। ধর্মীয় নীতিবোধ বলতে তারা ঘরের বাইরে না বের হওয়াকেই বুঝত। শাসন আর নিপীড়নের শিকার হয়ে তাদের দুর্ভাগ্য মেনে নিতে হত। কট্টরপন্থী ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের শাসনদণ্ড দেখিয়ে গৃহবাসকেই নারীর একমাত্র আবাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নারীসমাজ খুব ধীরে হলেও শিক্ষার আহ্বানে সাড়া দিতে শুরু করে। মুসলমান নারীদের ক্ষেত্রে একমাত্র বেগম রোকেয়া কিছুটা আলো ছড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি নিজেই ঘর থেকে বের হয়ে মুসলিম নারীদের সচেতন করার চেষ্টা করেন।
নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা
নারীশিক্ষার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা মাত্র ২৬ শতাংশ। বিপুল সংখ্যক নারী এখনও কুসংস্কার ও অজ্ঞতার অন্ধকার কাটিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি। ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। যেমন—পর্দার কড়াকড়ি এখনও বড় একটি বাধা। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও চরম দারিদ্র্যও নারীশিক্ষার পথে বড় বাধা। সবচেয়ে বড় কথা, বিপুল সংখ্যক নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনার জন্য যে বড়মাত্রার উদ্যোগ, আয়োজন ও অবকাঠামো দরকার, তা আমাদের দেশে নেই।
নারীশিক্ষার গুরুত্ব
নারীশিক্ষা একটি সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষিত নারী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—তিন ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। নারী শিক্ষিত হলে পরিবারে সঠিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে, সন্তানরা ভালো শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং পরিবারে সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষিত নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, আত্মনির্ভরশীল হতে পারে এবং সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও নেতৃত্ব—সব ক্ষেত্রেই নারীশিক্ষা অপরিহার্য। তাই একটি সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত সমাজ গঠনে নারীশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, “তোমরা যদি আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, তাহলে আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।”
নারী শিক্ষা প্রসারের উপায়
প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নারীসমাজ যাতে শিক্ষার সুযোগ পায়, সে জন্য প্রয়োজন প্রচলিত ধারার পাশাপাশি বিশেষ ধরনের শিক্ষা-পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে রেডিও, টিভি ইত্যাদি মাধ্যমে কর্মমুখী শিক্ষাকর্মসূচি চালু করা দরকার। নিরক্ষর নারীর প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে—তাই এসব কর্মসূচিকে গ্রামীণ সমাজ ও পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। এসব দিক বিবেচনায় রেখে নারীশিক্ষা সম্প্রসারণে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—
১.সামাজিক সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন স্কুলগামী ছাত্রীদের জন্য যাতায়াত নির্বিঘ্ন হয়।
২.প্রতিটি নারীর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায়ে ছোট ছোট স্কুল স্থাপন, যাতে বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব কম থাকে।
৩.সরকারি উপবৃত্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে নারীদের শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করা।
৪.সারা দেশে নারীশিক্ষা আন্দোলন গড়ে তোলা এবং শিক্ষানুরাগী সম্প্রদায়কে এতে সম্পৃক্ত করা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিশেষভাবে এ কাজে নিয়োগ করা যেতে পারে।
৫.ধর্মীয় বাধা, সামাজিক কুসংস্কার ও আর্থিক দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক প্রণোদনা সৃষ্টি করা। গণমাধ্যম ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এ কাজে কাজে লাগানো।
বি. দ্রঃ“এখানে ধর্মীয় কিছু বিষয়ের বিরোধিতা করা হয়েছে, কিন্তু এগুলো কোরআন বা হাদিসে নেই; আর থাকলেও এতটা কড়াকড়িভাবে নেই।”
সুত্রঃ
