যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। এর বিষক্রিয়ায় আমাদের গোটা সমাজ আক্রান্ত। বর্তমানে যৌতুক প্রথার ভয়াবহতা বাড়লেও এর প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই চলছে। নারীজীবনে এ প্রথা অকল্পনীয় অভিশাপ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছে এই অভিশপ্ত প্রথার কারণে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে যৌতুকের অভিশাপে। যৌতুকের করালগ্রাসে নারীর সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা লাঞ্ছিত হচ্ছে। যৌতুক প্রথা কেবল নারীকে মর্যাদাহীনই করে না, বরং গোটা নারী জাতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে সমগ্র দেশের উন্নয়নের গতিকে মন্থর করে দিয়েছে।
যৌতুক প্রথা কাকে বলেঃ যৌতুক প্রথা হলো—বিয়ের সময় কনের পক্ষ থেকে বরপক্ষকে অর্থ, আসবাবপত্র, স্বর্ণালংকার কিংবা মূল্যবান সামগ্রী দেওয়ার যে অনৈতিক সামাজিক রীতি প্রচলিত আছে, তাকে যৌতুক প্রথা বলা হয়। সমাজে এটি অনেক সময় ‘রেওয়াজ’ বা ‘সম্মান’ হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে এটি একটি ঘৃণ্য ও নিষিদ্ধ প্রথা, যা মেয়েদের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে। যৌতুক দাবি করা বা দেওয়া—দুটোই বেআইনি এবং এ কারণে বহু পরিবার দুঃশ্চিন্তা, ঋণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। যৌতুক প্রথা কেবল বিয়েকে ব্যবসায়িক লেনদেনে পরিণত করে না, বরং নারীকে অবমূল্যায়ন করে।
যৌতুক প্রথার ইতিহাসঃ যৌতুক প্রথার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে কিছু সূত্র থেকে জানা যায় যে, প্রথমে এই প্রথা মূলত হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে হিন্দু সমাজ থেকে এটি মুসলিম সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশেও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হলেও এর বাস্তবায়ন সফল হয়নি। পরবর্তীতে আইনগত ও সামাজিক নানা প্রচেষ্টার মাধ্যমে যৌতুক প্রথা প্রতিরোধে কিছু সাফল্য এলেও সমাজের বহু স্থানে এটি এখনও প্রচলিত রয়েছে।
যৌতুক প্রথার কারণ ও কুফলঃ যৌতুক প্রথার প্রধান কারণ অর্থলোভ। কিছু ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষ যৌতুককে আর্থিক লাভের উৎস হিসেবে দেখে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে যৌতুক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার এর বিরোধিতা করতে ভয় পায়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য, কুসংস্কার এবং নারীকে অবমূল্যায়ন—এসব কারণেও যৌতুক প্রথা টিকে আছে। নারীর অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা, অজ্ঞতা এবং পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা যৌতুকের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যৌতুকের বিরূপ প্রভাবঃ যৌতুক প্রথা সমাজে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করেছে। যৌতুক না দিলে অথবা কম দিলে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা জীবনও হারান। প্রতিনিয়ত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির চাহিদা মেটাতে গিয়ে দরিদ্র পিতামাতা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এ প্রথা নারী–পুরুষের ভেদাভেদ বাড়ায়, নারীকে পণ্যে পরিণত করে এবং সামাজিক কাঠামো ধ্বংস করে। এটি নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে এবং কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ায়। ফলে নারী জীবনে এটি এক অবমাননাকর ও আত্মমর্যাদাহানিকর অভিশাপ।
যৌতুক প্রথার প্রতিকারঃ
১) শিক্ষার প্রসার
*মেয়ে–ছেলে উভয়ের জন্য সমান শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
*নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষা জরুরি।
*শিক্ষিত মানুষ যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া—দুটোই কম করে।
২) সচেতনতা বৃদ্ধি
*স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও সামাজিক ক্লাবে যৌতুকবিরোধী প্রচার চালাতে হবে।
*গণমাধ্যম, নাটক, ভিডিও, সোশ্যাল মিডিয়ায় যৌতুকের ক্ষতিকর দিক প্রচার করা জরুরি।
৩) পরিবারে মানসিক পরিবর্তন
*ছেলে পক্ষকে বুঝাতে হবে—মেয়ে কোনো বোঝা নয়; সে সমান অধিকারপ্রাপ্ত।
*বিবাহে ছেলে বা তার পরিবারের “দাবি” করার অধিকার নেই।
৪) ইমাম, শিক্ষক ও সমাজনেতাদের ভূমিকা
*খুতবা, ওয়াজ, ক্লাস ও বক্তৃতায় যৌতুকের কুফল তুলে ধরা।
*বিয়ে পড়ানোর সময় যৌতুকবিরোধী শর্ত স্মরণ করানো।
৫) ভুক্তভোগীদের সহায়তা
*যৌতুক নির্যাতিত নারীদের আইনি ও সামাজিক সহায়তা দিতে হবে।
*হটলাইন, নির্যাতন সেল, ও থানার উইমেন সাপোর্ট ডেস্ক ব্যবহার করতে হবে।
সূত্রঃ
১.যৌতুক প্রথার উৎপত্তি হয়েছে কীভাবে? ব্যাখ্যা করো।
৩.যৌতুক প্রথার ইতিহাস, কারণ, কুফল ও প্রতিরোধের উপায় অনুচ্ছেদ প্রতিবেদ
