একদা এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ এবং দয়ালু। তার রাজ্য ছিল খুবই সুন্দর, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ। পাহাড়, নদী, বন, সবুজ ক্ষেত-খামার—সবই একে অপরের সঙ্গে সুন্দরভাবে মিশে গিয়েছিল। রাজ্যের মানুষরা রাজার প্রতি গভীর ভক্তি অনুভব করত। তারা জানত, এই রাজা কখনো অন্যায় করবেন না, ও মানুষদের প্রতি সদয় থাকবেন। রাজ্যের প্রজারা শান্তিতে বসবাস করত, কারণ তারা জানত যে, তাদের রক্ষাকারী রাজা সবসময় তাদের কল্যাণের চিন্তা করেন।
কিন্ত পার্শ্ববর্তী একটি খারাপ এবং দুষ্ট্র রাজা এই সুন্দর রাজ্যের প্রতি হিংসা প্রকাশ করলেন। তিনি কিছু অসন্তুষ্ট প্রজাকে উসকে দিলেন, যাতে তারা নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে। এরপর তিনি তার সৈন্যদের নিয়ে এই শান্তিপূর্ণ রাজ্যের উপর আক্রমণ চালালেন। যুদ্ধ শুরু হলো, রাজার সৈন্যরা বীর বিক্রমে লড়াই করতে লাগল। তারা প্রত্যেকটি যুদ্ধে প্রাণপণ লড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর শত্রুর চাপ সইতে না পেরে তার পিছু হতে বাধ্য হলো।
যুদ্ধের সময়ে রাজাও আহত হন। তাঁর একটি পা আহত এবং শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। রাজা বুঝতে পারলেন, অবিলম্বে নিজেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। তার ঘোড়াও ছিল আহত, তিনি একটি ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যান। তিনি জানতেন, যদি তাঁর পরিচয় প্রকাশ পায়, শত্রুরা তাঁকে ধরে ফেলতে পারে। তাই তিনি ছদ্মবেশ গ্রহণ করে গ্রামের দিকে চলে গেলেন।
গ্রামে পৌঁছে তিনি সাহায্যের জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু গ্রামের মানুষরা প্রথমে ভয়ে তাকাল। তারা ভেবেছিল এই পথিক হয়তো শত্রুর লোক। কেউ তাকে আশ্রয় দিতে আগ্রহী হলো না। তখন একজন দয়ালু কৃষক সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি জানতেন না যে এই পথিক আসলে তাদের রাজা। কৃষক পথিককে খাবার দিলেন, নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করলেন এবং যত্নসহকারে সেবা করলেন। রাজা কৃষকের উদারতা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, প্রকৃত দয়া কোনো পদ বা শক্তির জন্য প্রয়োজন হয় না।
কৃষকের ছোট ছোট সংসার, সরল জীবন এবং সদয় মন রাজার হৃদয় স্পর্শ করল। তিনি রাতে কৃষকের সঙ্গে গল্প করলেন, কিন্তু নিজের পরিচয় প্রকাশ করেননি। কৃষক রাজাকে এক পরিবারের মতো স্নেহের সঙ্গে দেখাশোনা করলেন। রাজা রাতভর ভাবলেন, এমন মানুষদের জন্যই রাজা হওয়া উচিত। মানুষের কল্যাণের জন্যই ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করা উচিত।
পরদিন, রাজা নিরাপদে রাজধানীতে ফিরে এলেন। এবং আবার শক্তি জোগাড় করে শত্রুকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। শত্রুর রাজা হেরে পিছু হটতে বাধ্য হল, আর শান্তিপূর্ণ রাজ্য আবার তার প্রাচীন শান্তি ফিরে পেল।
যুদ্ধজয়ের পর, রাজা রাজসভায় ফিরে এলেন। তিনি তাঁর সেনাপতিকে নির্দেশ দিলেন যাতে সেই গ্রামের দয়ালু কৃষককে রাজসভায় হাজির করা হয়। কৃষককে সম্মান জানিয়ে রাজা রাজবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। শুধু তাই নয়, কৃষকের পুত্রকেও মন্ত্রী পদে নিয়োগ দিলেন। কৃষক ও তার পরিবার রাজবাড়িতে বসবাস করতে লাগলেন।
এই ঘটনাটি শুধু একটি যুদ্ধজয় বা ক্ষমতার প্রদর্শন ছিল না। এটি ছিল মানুষের প্রতি সত্যিকারের দয়া, সহানুভূতি এবং ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা। রাজা বুঝতে পারলেন, প্রকৃত শক্তি শুধু সৈন্য বা অস্ত্রের মধ্যে নয়, বরং মানুষের প্রতি সদয় মনোভাব ও উদারতায় নিহিত।
কৃষকের ছোট ছোট সেবা, নিঃস্বার্থ দয়া এবং সততার কারণে রাজা আরও গভীরভাবে মানবতা ও ন্যায়বিচার শিখলেন। তিনি বুঝলেন, রাজা হওয়া মানে শুধু ক্ষমতা ব্যবহার করা নয়, মানুষের কল্যাণ, দয়া এবং ন্যায় নিশ্চিত করা। কৃষকের এই উদারতা রাজাকে দেখিয়েছে, সত্যিকারের বীরত্ব কখনো যুদ্ধ বা বলবৎ ক্ষমতায় সীমাবদ্ধ নয়।
রাজ্যের মানুষরা আরও শান্তি ও সমৃদ্ধিতে জীবন কাটাতে লাগল। তারা জানত যে, তাদের রক্ষা করার জন্য যে রাজা রয়েছে, তিনি শুধু সৈন্য বা সেনাপ্রধান নন, বরং মানুষের দয়া ও ভালবাসার প্রকৃত রক্ষক। রাজা দিন দিন আরও ন্যায়পরায়ণ, বুদ্ধিমান এবং দয়ালু হয়ে উঠলেন। তিনি কৃষকের মতো মানুষের ছোট ছোট দয়া ও ত্যাগের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকলেন।
এই গল্পটি আমাদের শেখায়, যে সত্যিকারের শক্তি, ন্যায়, সাহস ও দয়া কখনো অস্ত্র বা পদমর্যাদার মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় না। মানুষের হৃদয় জয় করলেই প্রকৃত বিজয় অর্জিত হয়। সেই কারণে, দয়ালু কৃষক ও ধার্মিক রাজা একসঙ্গে রাজ্যকে শান্তি, সুখ এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে গেলেন।
এইভাবে এক সাহসী রাজা, এক উদার কৃষক এবং তার পরিবার রাজ্যের সুখ ও শান্তি নিশ্চিত করলেন। তারা প্রমাণ করলেন যে ন্যায়, দয়া এবং উদার মনই মানব সমাজের সেরা শক্তি।
সূত্রঃব্যক্তিগত লেখা
