আশারায় মুবাশশাঃ সেই ১০ সৌভাগ্যবান সাহাবী সাহাবীর জীবনী (পর্ব-১)

আবু বকর (রা.)

নাম, পরিচয় ও গঠন-প্রকৃতি

মাতা-পিতার পক্ষ থেকে রাখা-নাম ছিল আবদুল্লাহ। আবু বকর হল তার ডাকনাম। আতিক আর সিদ্দিক হল উপাধি।
তিনি উজ্জ্বল গৌড়-বর্ণের অধিকারী ছিলেন। দেহ ছিল পাতলা ছিপছিপে। হালকা-পাতলা গড়নের এই মানুষটির ললাট ছিল প্রশস্ত। শেষ বয়সে চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল। সাদা চুলে তিনি মেহেদি ব্যবহার করতেন।
সিদ্দিকে আকবর হজরত আবু বকর (রাঃ) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রায় সমবয়সের ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর চেয়ে দুবছর কয়েক মাস ছোট ছিলেন তিনি। ইনতেকালও করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর দুবছর কয়েক মাস পর।

শৈশব

হজরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর বাল্যবন্ধু। বাল্যকাল থেকে সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর অধিকাংশ বাণিজ্য সফরে তিনি সঙ্গে থাকতেন।
একবার সিরিয়ার বাণিজ্য সফরে তিনি সঙ্গী ছিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর বয়স ছিল বিশ এবং আবু বকর (রাঃ)–এর বয়স আঠারো।
সিরিয়া সীমান্তে এক পাদ্রি আবু বকর (রাঃ)–কে নবুওয়তের ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন— “গাছের নিচে বসে থাকা ওই লোকটি একদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী হবেন।”

ইসলাম গ্রহণ

সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন খাদিজা (রাঃ)। এরপর আলি (রাঃ), তারপর যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ), এরপর আবু বকর (রাঃ)।
পরিবার–বহির্ভূত প্রথম মুসলিম ছিলেন তিনি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন— “বিনা দ্বিধায় কেবল আবু বকরই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।”

কয়েকটি বৈশিষ্ট্য

১. সঙ্গীদের মাঝে তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে ইসলাম ঘোষণা করেন।
২. প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার প্রথম উদাহরণও তিনিই দেন।
৩. তাঁর দাওয়াতে ওসমান গনি (রাঃ), জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাঃ), সা‘দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) সহ আশারায়ে মুবাশশারা ইসলাম গ্রহণ করেন।
৪. দ্বিধাহীনচিত্তে ইসলাম গ্রহণ।
৫. মিরাজের খবর নির্দ্বিধায় গ্রহণ করায় “সিদ্দিক” উপাধি লাভ।


মদিনা অভিমুখে যাত্রা

তিনদিন তিনরাত গুহায় থেকে তাঁরা মদিনার পথে রওনা হন।
মদিনায় পৌঁছে রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন আবু আইয়ুব আনসারি (রাঃ)–এর বাড়িতে; আবু বকর (রাঃ) ছিলেন জারিবা ইবনে জায়েদ (রাঃ)–এর বাড়িতে।
সাত মাস পর আবু বকর (রাঃ)–এর আর্থিক সহযোগিতায় একটি জমি ক্রয় করে সেখানে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক মসজিদে নববী।


যুদ্ধের ময়দানে

বদর যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর জন্য তাবু তৈরি করেন এবং খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দেন।
একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে নবীজির হেফাজত— দুই কাজই তিনি করছিলেন অসাধারণ দক্ষতায়।
এ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ডানদিক পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর।
হজরত আলি (রাঃ) বলেন—
“সর্বাপেক্ষা বাহাদুর ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)। তিনি একাই নবীজির তাবু পাহারা ও সেনা পরিচালনা করতেন।”

উহুদ, হুনাইন, খন্দক, হুদায়বিয়া— প্রতিটি বড় ঘটনায় তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর অন্তিমকালে

অসুস্থতার কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর পক্ষে ইমামতি সম্ভব না হলে তিনি মা আয়েশা (রাঃ)–এর মাধ্যমে আবু বকর (রাঃ)-কে নির্দেশ দেন।
এই নির্দেশই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং পরবর্তী খেলাফতের ইঙ্গিত।


রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর ইনতেকালের পর

রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর ইন্তেকালে সবাই শোকে দিশেহারা হয়ে পড়লে আবু বকর (রাঃ)–ই সবাইকে স্থির করেন।
তিনি বলেন—
“যারা আল্লাহর ইবাদত করে তারা জেনে রাখুক— আল্লাহ চিরঞ্জীব। আর মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল— তিনি ইন্তেকাল করেছেন।”
এ বক্তব্যে সবাই স্বাভাবিকতা ফিরে পায়।


দাফন ও খেলাফত

সমাধিস্থ করার স্থান নির্ধারণে তিনি নবীর বাণী শোনান—
“নবিগণের ইন্তেকাল যেখানে হয়, সেখানেই তাদের দাফন।”
ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে তাঁর ঘরেই দাফন করা হয়।
এরপর সর্বসম্মতভাবে আবু বকর (রাঃ) প্রথম খলিফা হন।

খেলাফত লাভ

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতেকালের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল খলিফা নিয়োগ। এ বিষয়ে প্রথমদিকে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও, যখন হজরত আবু বকর (রাঃ)–এর নাম প্রস্তাব করা হয়, তখন কেউ এর বিরোধিতা করেননি; সকলে একযোগে মেনে নেন। হজরত ওমর (রাঃ)–এর ঘোষণা দেওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সকল সাহাবাই হজরত আবু বকর (রাঃ)–এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

খেলাফত লাভের পর হজরত আবু বকর (রাঃ) কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতেকালের পূর্বে হজরত উসামা (রাঃ)–এর নেতৃত্বে একটি জিহাদি কাফেলা প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু ইনতেকালের কারণে ধর্মত্যাগ, জাকাত অস্বীকার, মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি ইত্যাকার ফেতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

এ পরিস্থিতিতে সাহাবাদের অনেকেই এ বাহিনী না পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিন্তু হজরত আবু বকর (রাঃ) কঠোরভাবে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কেউ কেউ বিশ বছরের এই নওজোয়ানের পরিবর্তে অন্য কাউকে সেনাপতি করার আবেদন করেন। কিন্তু হজরত আবু বকর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে মোটেই রাজি হলেন না।

সেদিন তাঁর মধ্যে কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পেলে দীনের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।


অবদান

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতেকালের পর সব ধরনের ফেতনা তিনি কঠোর হাতে দমন করে উম্মতের ঐক্য ধরে রাখেন। তিনি সর্বপ্রথম কুরআন সংকলনের কাজ আনজাম দেন। অহীর লেখকদের নিকট কুরআনের অংশগুলো সংরক্ষিত ছিল। তিনি সেগুলো একত্র করার নির্দেশ দেন এবং একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা হয়।

তাঁর এই মোবারক উদ্যোগের ফলে কুরআন সংকলিত হয়। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)–এর উম্মতের প্রতি শ্রেষ্ঠ অবদান হলো কুরআন সংকলন এবং মুরতাদদের বিদ্রোহ দমন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) যে কাজের সূচনা করেছিলেন, তাঁর আমলে তা অব্যাহত থাকে। তাঁর খেলাফতে ইসলামি রাষ্ট্র বিস্তারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তাঁর পথ অনুসরণ করেই পরবর্তী যুগে মুসলমানরা সিরিয়া, ইরান, ইরাক ইত্যাদি দেশ জয় করতে সক্ষম হয়।


হাদিস বর্ণনা

হাদিস বর্ণনায় হজরত সিদ্দিকে আকবর (রাঃ)–এর রেওয়ায়াত সংখ্যা কম হলেও তা অত্যন্ত বিশুদ্ধমানের। কারো মতে তিনি পাঁচশত, কারো মতে দেড়শ হাদিস বর্ণনা করেছেন।

স্বল্প সংখ্যার কারণ—
১) ইনতেকালের পর তাঁর কাছে বর্ণনার মতো সময় ছিল কম; তিনি শত্রু দমন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন।
২) তিনি হাদিস বর্ণনায় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন এবং হাদিসকে কুরআনের মতো মর্যাদা দিতেন।


পরিবার ও ব্যক্তিজীবন

তিনি চারটি বিবাহ করেছিলেন— ইসলাম গ্রহণের পূর্বে দুটি এবং পরবর্তীতে দুটি।
প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল কুতায়লা; তাঁর গর্ভে আবদুল্লাহ জন্ম নেন। হজরত আবু বকর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পর তাঁকে দাওয়াত দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়।

দ্বিতীয় স্ত্রী উম্মে রুমান (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর গর্ভে আবদুর রহমান ও আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন।

৮ হিজরিতে তিনি তৃতীয় এবং পরবর্তী সময়ে চতুর্থ বিবাহ করেন উম্মে হাবিবা নামক এক মহিলাকে। ইনতেকালের সময় শেষোক্ত দুই স্ত্রী জীবিত ছিলেন।

হিজরতের পরও তিনি ব্যবসা চালিয়ে যান।


ইনতেকাল

১৩ হিজরির ৭ জুমাদাল উখরা হজরত আবু বকর (রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। ১৫ দিন অসুস্থ থাকার পর ২১ জুমাদাল উখরায় ইনতেকাল করেন।

হজরত মা আয়েশা (রাঃ)–এর হুজরায়, রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর পাশে, একটু পূর্ব দিকে তাঁকে দাফন করা হয়।

তিনি দুই বছর তিন মাস দশদিন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।

চলবে……….

সুত্রঃজান্নাতি দশ পুরুষ জীবন ও কর্ম