আশারায় মুবাশশারাঃ সেই ১০ সৌভাগ্যবান সাহাবী সাহাবীর জীবনী (পর্ব-২)

হযরত ওমর রা.

নাম ও বংশপরিচয়

নাম, ওমর। পিতার নাম, খাত্তাব। উপাধি ফারুক। ডাকনাম আবু হাফস। মাতার নাম, হানতামা বিনতে হাশিম। কারো মতে হানতামা বিনতে হিশাম। তিনি কোরাইশ বংশের আদি গোত্রের লোক। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের সাথে তার বংশের মিল রয়েছে।

শৈশবকাল

হযরত ওমর রা. এর জন্ম ও বাল্যজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হল এই যে, পিতার অত্যন্ত আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। তার মধ্যে বুদ্ধি ও সাহসিকতা প্রস্ফুটিত ছিল শৈশব থেকেই। তার পিতা ছিলেন সম্রান্ত এবং শিক্ষিত। হযরত আমর ইবনে আস রা. বলেন, একদিন আমরা ক’জন বসে ছিলাম। এমন সময় শোরগোল শোনা গেল। সংবাদ নিয়ে জানা গেল খাত্তাবের একটি ছেলে হয়েছে। এতে বোঝা যায় ওমরের জন্মের কারণে আনন্দোৎসব হয়েছিল।

হযরত ওমর রা. এর পিতা শিক্ষিত হওয়ার কারণে সন্তানের শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দেন। তাই অল্প-স্বল্প বিদ্যা অর্জন তিনি করেছেন। তবে তাকে তার পিতা কাদিদ নামক স্থানে উট চড়ানোর দায়িত্ব দেন। সাথে সাথে তীর চালনা, কুস্তিগিরি এবং যুদ্ধবিদ্যায়ও সমান নৈপুণ্য অর্জন করেন। আরবের বিখ্যাত উকাজ মেলায় তিনি কুস্তির প্রতিযোগিতা করতেন। তার খেলাফতকালে তার উট চরানোর স্থান দিয়ে একদিন অতিক্রম করার সময় তিনি বলেছিলেন, মনে পড়ে আমি পশমী কাপড় পরে এই মাঠে উট চরাতাম, ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিলে পিতামহোদয়ের হাতে প্রহৃত হতাম। কিন্তু আজ এমন দিন এসেছে, এক আল্লাহ ছাড়া আমার উপর কর্তৃত্ব করার কেউ নেই। তিনি যৌবনকালেই নিজ বুদ্ধি-বিবেক,.. জ্ঞান-গরিমা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা আরবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এ ছাড়াও ঘোড়সওয়ারিতে ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। ভাষা সাহিত্যও ছিল হযরত ওমরের স্বভাবজাত গুণ। বিখ্যাত ঐতিহাসিক বালাজুরি লিখেছেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতকালে গোটা কোরাইশে মাত্র সতেরজন লোক লেখাপড়া জানতেন। হযরত ওমর রা. তাদের একজন ।

আরবের প্রাচীন কবিদের কবিতা প্রায় সবই তার মুখস্থ ছিল। আরবীয় কাব্যসমালোচনার বিজ্ঞানভিত্তিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে তিনিই ।

ইসলামগ্রহণ

জন্মগতভাবে তিনি মূর্তিপূজক ছিলেন। মূর্তিকে ভালবাসতেন আর তাওহিদকে ঘৃণা করতেন। রাসুলের দীনের দাওয়াত কবুল করার ফলে পিতা কর্তৃক যায়েদ ইবনে সায়িদের বিরোধিতা তিনি স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। তাই তিনিও দাঁড়িয়ে গেলেন ইসলামের বিরুদ্ধে। তার সাহসিকতা আর সততার কথা সবাই জানতেন। এমন একজন সাহসী পুরুষের দরকার ছিল ইসলামের জন্য। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ, ওমর কিংবা আবু জাহল- যেকোনো একজনের মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর। আল্লাহ পাক তার দোয়া কবুল করলেন এবং হযরত ওমরকে মনোনীত করলেন। কারণ হযরত ওমর ছিলেন সত্যের সন্ধানী। যতক্ষণ ইসলামের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা হয়নি ততক্ষণ বিরোধিতা করেছেন। যখন সত্যকে সত্য মনে হয়েছে তখন কবুল করেছেন। এক কথায়, হযরত ওমরের ছিল সত্য মেনে নেওয়ার দুর্লভ মানসিকতা আর দুর্ভাগা আবু জাহলের ছিল বিরোধিতা করার নিকৃষ্ট স্বভাব। তাই রাসুলের বাড়ির কাছে থেকেও সে ছিল দুশমন আর ওমর রা. দূরে থেকেও হলেন বন্ধু।

তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। তিনি ভাবলেন, সবাই মুহাম্মদের কারণে ধর্মান্তরিত হচ্ছে, সুতরাং মুহাম্মদকেই শেষ করতে হবে। আবার মনের আরেক কোণায় এও দোলা দিচ্ছিল, যারা ধর্মান্তরিত হয়েছে, তারা কেউ তা ছেড়ে দেয়নি। প্রয়োজনে বাড়ি-ঘড় ছেড়েছে। তা হলে সত্য কোনটা? তাই তিনি তরবারি কোষমুক্ত করে এগিয়ে গেলেন রাসুলের মাথাটা নিয়ে আসতে। তখন গাছের পাতারা আর আকাশের পাখিরা বলছিল, এই ওমর, যাচ্ছ কোথায়? মাথা কাটতে নাকি তোমার মাথাটা তার কাছে সমপর্ণ করতে। হযরত ওমর রা. কে বাধা দেয় এই সাহস কারো নেই। কাফেররা তাকে দেখে আনন্দে নেচে উঠল। আর মুসলমানরা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল। পথে নওমুসলিম নায়িমের সঙ্গে তার সাক্ষাত হল। তিনি বললেন, কোথায় যাচ্ছ? ওমর বললেন, মুহাম্মদের মাথা কাটতে ।

হযরত ওমর রা. এর ইসলামগ্রহণ ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। তখন পর্যন্ত ৩০ কি ৪০ জন ইসলামগ্রহণ করেছে। তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতের অনুমতি পাওয়া যায়নি। কিন্তু হযরত ওমর ইসলাম গ্রহণের পর নিজ থেকেই প্রকাশ্যে দাওয়াতের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণের পর সেই রাতেই চিন্তা করলাম, মক্কার মধ্যে রাসুলের সবচেয়ে কট্টর দুশমন কে আছে, আমি তাকেই প্রথমে জানাব। দেখলাম সে হলো আবু জাহল। তাই পর দিন সকাল হতেই আমি তার বাড়িতে কড়া নাড়লাম। আবু জাহল বেরিয়ে এসে বলল, কী ব্যাপার, কী মনে করে?

বললাম, আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্ম গ্রহণ করেছি।

একথা শুনে সে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। আর বলল, আল্লাহ তোমাকে কলংকিত করুক ।

হযরত ওমর বললেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমি রাসুলকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কি সৎপথে আছি?

তিনি বললেন, সেই পাক জাতের কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা সকলেই সৎপথে আছ।

হযরত ওমর রা. বললেন, তা হলে সত্য গোপন থাকবে কেন। অবশ্যই তা প্রকাশ করব। সেমতে মুসলমানরা দুই সারিতে বিভক্ত হয়ে বের হলেন। এক সারিতে হযরত হামযা রা.। অন্য সারিতে হযরত ওমর রা.।রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে কাবা শরীফে পৌঁছে ইসলামের ঘোষণা করেন এবং নামায আদায় করেন। কারো এই সাহস ছিল না, বাধা দিবে। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফারুক উপাধিতে ভূষিত করেন। তার ইসলাম গ্রহণকালে সাহাবায়ে কেরাম কাবার চত্বরে বসে গল্প করতেন। নামায আদায় করতেন। কেউ কিছু বলত না। ওমর রা. এর ইসলাম গ্রহণের পর জিবরাইল আ. এসে জানালেন ওমরের ইসলাম কবুলে আকাশের সবাই আনন্দ প্রকাশ করছে। ইসলাম গ্রহণের সময় হযরত ওমরের বয়স ছিল ৩৪ বছর। হযরত ওমর ছিলেন রাসুলের তের বছরের ছোট।”

হিজরত

কোনো সন্দেহ নেই যে, হযরত ওমর রা. এর ইসলামগ্রহণ মুসলমানের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। তার ইসলাম গ্রহণের পর সাহাবাগণের নিজ নিজ ইসলাম প্রকাশ করার মনোবল সৃষ্টি হল। প্রকাশ্যে ইবাদত করার সুযোগ পেলেন। যেন কাফেরদের একহাত ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু কাফেররা দমে যায়নি। তাদের বিরোধিতা কিছুটা কমলেও থেমে থাকেনি। হযরত ওমর রা. সবার মত অত্যাচার সহ্য করতে লাগলেন। এমন সময়ও এলো যে, তিনি রাসুলের কাছে হিজরতের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু তার হিজরত অন্যান্য মুসলমানের হিজরত থেকে কিছুটা ভিন্ন। সবাই গোপনে হিজরত করেছেন আর তিনি করেছেন প্রকাশ্যে এবং ঘোষণা দিয়ে। হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর তিনি সাথীদেরকে নিয়ে কাবা শরীফে গমন করেন । তাওয়াফ করেন। প্রকাশ্যে ইবাদত করেন। মুশরিকরা চারপাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। বাধা দেওয়ার সাহস কারো হয়নি। তিনি নামায শেষে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি হিজরত করছি, যদি কোনো সন্তান মায়ের বুক খালি করতে চাও তা হলে বাধা দিতে এসো। কিন্তু কেউ সামনে বাড়েনি। তিনি বীরদর্পে মদিনায় হিজরত করেন।

আশারায়ে মুবাশশারা।মদিনা ছিল মুসলমানদের জন্য নিরাপদ ভূমি। হযরত ওমর প্রথমে কোথায় অবস্থান নেন। রিফাআ বিন আবদুল মুনাথের নামক এক ব্যক্তি তাকে মেহমান হিসাবে গ্রহণ করেন। পরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতকালে মুহাজির ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃ- বন্ধন স্থাপন করেন, যা পৃথিবীতে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তিনি বনু সালেম গোত্রের সরদার আতবান ইবনে মালেক রা. এর সাথে ওমরের ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দেন ।

হযরত বারা ইবনে আযেব রা. বলেন, আমাদের কাছে সর্বপ্রথম হিজরত করে আসেন মুসআব ইবন ওমায়ের রা.। তার পর আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা.। তার পর হযরত ওমর রা. বিশজন আরোহীসহ এলেন। আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসুল কী করছেন? তিনি বললেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হিজরত করেছেন। অবশেষে রাসুল এলেন। সাথে ছিলেন আবু বকর রা.।

জিহাদে অংশগ্রহণ

বদর, অহুদ, খন্দক, হুনাইনসহ ইসলামের সকল জিহাদেই হযরত ওমর রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বদরযুদ্ধে মক্কার কোনো গোত্রই অবশিষ্ট থাকেনি। সবাই যুদ্ধে শরিক হয়েছে। কিন্তু হযরত ওমর রা এর ভয়ে তার গোত্র বনু আদি হতে কেউ আসেনি। বদরযুদ্ধে সর্বপ্রথম শহীদ হন ওমর রা. এর গোলাম মাহযা। হযরত ওমরই সর্বপ্রথম স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন যে, ইসলামের মোকাবেলায় কোনো আত্মীয়তার দায়বদ্ধতা নেই। তাই তিনি বদরযুদ্ধের বন্দিদের ব্যাপারে রায় পেশ করেছিলেন যে, প্রত্যেকেই তার আত্মীয়কে হত্যা করবে। হামযা করবে আব্বাসকে, আলি করবে আকিলকে আর আমি আমার আত্মীয়দেরকে। তার এই দৃঢ় এবং কুফুরের বিরুদ্ধে কাঠোর মনোভাব আল্লাহর পছন্দ হয়। যদিও এর বিপরীত সিদ্ধান্ত রাসুল গ্রহণ করেছিলেন।

অহুদযুদ্ধের পর যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের নিয়ে পাহাড়ের আড়ালে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন আবু সুফিয়ান সবার নাম বলে বলে ডাকছিল। রাসুলের নির্দেশে সবাই চুপ থাকলেন। আবু সুফিয়ান বলল, নিশ্চয় তারা সকলে নিহত হয়েছে। এ কথায় হযরত ওমরের পৌরুষে আঘাত লাগে। তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না । তাই তিনি বলে উঠলেন, ওরে আল্লাহর দুশমন, আমরা সবাই জীবিত। আবু সুফিয়ান বলল, হুবলের জয় হোক। তখন রাসুলের ইঙ্গিতে হযরত ওমর বললেন, আল্লাহই মহান ও সম্মানী ।

খন্দকের যুদ্ধে এক স্থানের পরিখা খননের দায়িত্ব তার উপর পড়েছিল। সেখানে আজও তার নামে নির্মিত মসজিদ সেই স্মৃতি বহন করে আছে। তার সেই পরিখার স্থান দিয়ে অতিক্রম করার সাহস কোনো কাফের করেনি। খননের কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন তার নামায কাজা হয়ে গিয়েছিল। তিনি রাসুলের কাছে এসে বললেন, শত্রুরা আমাকে নামায পড়তে দেয়নি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আমিও পড়তে পারিনি।

হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন তিনি রণসাজে সজ্জিত হয়ে ছিলেন। তিনি খবর শোনতে পেলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইয়াত করছেন। শুনে দৌড়ে গিয়ে বাইয়াত হলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি বাহ্যত মুসলমানদের বিপক্ষে অপমানজনক মনে হলো। তাই প্রথমে আবু বকর রা. তার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে তিনি বলতে থাকেন, আমরা কি হকের উপর নেই? ইসলাম কি সত্য নয়? বলা হলো, অবশ্যই । রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আল্লাহর রাসুল। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই করি না। ফলে তিনি শান্ত হলেন এবং অনুতপ্ত হলেন। নফল রোজা রেখে, নামায আদায় করে, গোলাম আযাদ করে এবং দান-খয়রাত করে এই গোস্তাখির কাফ্ফারা আদায় করলেন।

খায়বর যুদ্ধে একটি দূর্গ জয় করা সম্ভব হচ্ছিল না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে ঝাণ্ডা তুলে দিব, যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন। হযরত ওমর রা. বললেন, এই দিন ব্যতীত আমি কোনো দিন নেতৃত্ব লাভের আশা করিনি। কিন্তু এই গৌরব হযরত আলি রা. অর্জন করেন। হুনাইনের যুদ্ধেও মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে রেখেছিলেন যারা তাদের মধ্যে হযরত ওমর রা. অন্যতম। এ ছাড়াও তিনি সকল যুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করে ইসলামের বিজয়ে অবদান রাখেন। তার খেলাফতকালেই পৃথিবীতে ইসলাম দূর-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইয়াত করছিলেন। অন্য দিকে হযরত ওমর রা.- কেও এই সম্মানজনক কাজে অভিষিক্ত করেন।

স্বভাব ও প্রভাব

সততা ও সুবিচার, অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় পদক্ষেপ, ভ্রাতৃত্ব, সত্যের ক্ষেত্রে নম্রতা, সরলতা, দানশীলতা, আতিথেয়তা, আল্লাহর ইবাদত, দীন ও শরিয়তের প্রতি গভীর ভালবাসাই ছিল হযরত ওমর রা. এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো কুফুরের বেলায় কঠোরতা আর হকের ক্ষেত্রে নম্রতা। মূলত তিনি নরম স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। আর এই কারণেই হয়ত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমার পর কেউ নবী হলে ওমরই হতো। হযরত আবু বকর রা. যখন পরবর্তী খলিফা হযরত ওমর রা. কে নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন, তখন কেউ কেউ বাধ সাধলো। উত্তরে বলা হল, তিনি কঠোর বটে, তবে দায়িত্ব এলে তিনিও নরম হয়ে যাবেন। দেখা গেল পরবর্তী সময়ে তা-ই হয়েছে।

ঘটনা আছে, তার খেলাফতকালে এক বুড়িমাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, খলিফা কেমন? বুড়ি তাকে চিনত না। তাই বলল, খুব খারাপ। খেলাফতের সময় থেকে এক টাকাও আমাকে দেয়নি। তিনি বললেন, সবার খবর সে কিভাবে রাখবে? আপনি আপনার দুরবস্থা গিয়ে বলেন না কেন? বুড়ি বলল, সে খলিফা। তার দায়িত্ব সবার খবর নেওয়া। এমন সময় হযরত আলি রা. হে আমিরুল মুমিনীন বলে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে এলেন। বুড়ি এবার থরথর করে কাঁপতে লাগল। কিন্তু হযরত ওমর রা. তাকে পাঁচ হাজার দিনার দান করলেন। তিনি ছিলেন খুব হিসেবি, যেন আখেরাতের ভয়ে সবসময় কম্পমান। জামা-কাপড় ছিল সাদামাটা। বায়তুল মাল থেকে খলিফা হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মতই ভাতা নিতেন। তাঁর জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্র ছিল ব্যবসা। খেলাফতের দায়িত্ব বেড়ে গেলে ব্যবসায় মনোযোগ দিতে পারতেন না। তারপরও ভাতা বাড়াননি। একবার তার ছেলে আবদুল্লাহ বলেন, আব্বাজান, আপনি হাসান হুসাইনকে ভাতা বেশি দেন অথচ তারা আমার চেয়ে ছোট। জবাবে তিনি বলেন, তাদের নানার মত মর্যাদাশীল তোমার নানা কখনো হতে পারবে না।

পোশাক-পরিচ্ছেদের মত তার খাওয়াদাওয়াও ছিল সাধারণ মানের। একবার তিনি এক গ্লাস পানি চাইলে তাকে মধু মেশানো পানি দেওয়া হলো। তিনি পান করে বললেন, আমার ভয় হচ্ছে আল্লাহ আখেরাতের হিস্সা দুনিয়ায় দিয়ে দিচ্ছেন কি না। এ কথা বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। হযরত হাফসা রা. ও হযরত আয়েশা রা. তাকে বলেন, আপনার সাথে বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা ভালো ভালো জামা-কাপড় পরে আসে। আপনিও ভাল কাপড় পরুন। জবাবে তিনি বলেন, তুমি কি ভুলে গিয়েছ যে, একবার তুমি বিছানা ভাজ করে দিয়েছিলে আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সময় উঠে বললেন, হাফসা, তুমি আমাকে নরম বিছানায় শুইয়ে অলস বানিয়ে ফেলছো।

তিনি হযরত হুসাইন রা. এর পিছনে এ জন্য ঘুরতেন যে, তার খেলাফতকালে আল্লাহপাক মুসলমানদেরকে অনেক সম্পদ দান করলেও তিনি খাওয়ার মধ্যে যবের রুটি এবং তাতে সিরকা, লবণ, খেজুর ও মধুই পছন্দ করতেন। তাকে হযরত হাফসা বিনতে আবুল আস রা. বললেন, আপনি আরেকটু ভাল আহার করুন। তিনি বললেন, আখেরাতের ভয়ে খেতে পারি না । তার মধ্যে অহংকার ও ক্ষমতার লোভ ছিল না। খলিফা হওয়া সত্ত্বেও তিনি অনাথ ও বিধবাদের বিভিন্ন কাজ নিজ হাতে করে দিতেন। অথচ তখন তার ভয়ে সারা বিশ্ব কাঁপত। একবার হযরত ওমর রা. কে খোঁজতে কয়েকজন দূত এলো। লোকজন তাদেরকে একটি গাছ দেখিয়ে দিল। তারা সেখানে গিয়ে দেখল, একটি লোক গাছের ছায়ায় খেজুর পাতার উপর শুয়ে আছে। মাথার নিচে ইট। পিঠে খেজুর পাতার দাগ পড়ে আছে। তারা বলল, ভাই, খলিফা ওমরকে কোথায় পাব? তিনি বললেন, আমিই ওমর। কী বলবে বল। তারা এতটাই আশ্চর্য হয়েছিল যে, তারা ফিরে গিয়ে বলেছিল যে, খলিফা দেহরক্ষি ছাড়া চলাফেরা করে এবং সা’দাসিধে জীবনযাপন করে। তাকে দেখেই বিশ্ব কাঁপতে পারে। তাঁর প্রভাব ছিল তুলনাহীন। তিনি যতই সা’দাসিধে থাকুন না কেন, চেহারায় ছিল এমন দীপ্তি যে, তার সামনে অসৎ কথা বলার সাহস কেউ করত না । তার ভয়ে শয়তান কাছে ভিরত না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বললেন, ওমর, তোমার ভয়ে শয়তান অন্য রাস্তা দিয়ে চলে। শয়তানের উপরই যদি তার এমন প্রভাব থাকতে পারে তা হলে মানুষের উপর কেমন হতে পারে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হযরত ওমর রা. থাকলে লোকজন খুব সাবধানে কথা বলতেন। বিশেষ করে মুনাফিকদের ব্যাপারে তিনি এত কঠোর ছিলেন যে, হত্যাই তাদের একমাত্র বিচার মনে করতেন। মক্কা বিজয়ের পূর্বে হযরত হাতিব ইবনে আবু বালতা রা. যখন যুদ্ধের আগাম সংবাদ জানিয়ে মক্কায় চিঠি পাঠিয়ে দিলেন এবং পরে তা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পেরে উদ্ধার করেন তখন হযরত ওমর তরবারি হাতে মজলিসে দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, অনুমতি দিন। এই মুনাফিকের গর্দান আলাদা করে ফেলি । রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওমর, সে বদরী।

চলবে………