বদরের যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম সম্মুখ সমর

দ্বিতীয় হিজরী সালে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে খবর আসে, কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়া হতে মক্কার পথে অগ্রসর হচ্ছে। কাফেলার নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কাফেলাটির পিছু ধাওয়া করার আহ্বান জানালেন। তবে এর জন্য তিনি বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেননি। দ্রুত বের হওয়ার জন্য তিনি বেশি সময় পাননি, তাই তিনি ১১৩ জন সাহাবী নিয়ে বের হয়ে পড়েন। তাদের সঙ্গে ছিল ২টি ঘোড়া এবং ৭০টি উট। সাহাবীরা পালাক্রমে আরোহন করতেন।

অন্যদিকে আবু সুফিয়ান, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বের হওয়ার খবর পেয়ে দ্রুত মক্কায় লোক পাঠিয়ে সাহায্য চাইলেন। সংবাদ পেয়ে কুরাইশরা ১ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, সঙ্গে ছিল ১০০টি ঘোড়া ও ৭০০টি উট।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন কুরাইশদের প্রস্তুতির কথা জানতে পারেন, তখন সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। প্রথমে মুহাজিরগণ কথা বলেন। দ্বিতীয়বারও মুহাজিরগণই কথা বলেন। তৃতীয়বার যখন তিনি পরামর্শ চান, তখন আনসারগণ বুঝতে পারেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের উদ্দেশ্য করছেন। তখন সা’দ বিন মুআয (রা.) উঠে দাঁড়িয়ে আনসারদের পক্ষ থেকে বলেন:

“হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সম্ভবত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। সেই আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে—আপনি যদি আমাদেরকে ঘোড়া ছুটিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাহলে আমরা তাই করব। আপনি যেদিকে যেতে বলবেন, আমরা সেদিকেই যাব। এমনকি বারাকুল গামাদ পর্যন্ত যেতে বললেও আমরা পিছপা হব না।”

মিকদাদ বিন আসওয়াদ (রা.)-ও বলেন, “হযরত মুসা (আঃ)-এর অনুসারীরা যেমন বলেছিল, আমরা তেমন বলব না। তারা বলেছিল, ‘তুমি ও তোমার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসে থাকব।’ আর আমরা বলছি: আমরা আপনার ডান, বাম, সামনে এবং পেছন থেকে যুদ্ধ করব।”

এই সাহসী কথা শুনে হযরত মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত খুশি হন। তিনি বলেন, “তাহলে সামনে চলো এবং সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহ আমাকে কাফেরদের দুই দলের একটির ওপর বিজয় দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। আমি কাফের নেতাদের নিহত হওয়ার স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছি।”

২য় হিজরির ১৭ই রমজান, মদিনা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে মুসলিম ও কুরাইশরা প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.), আর কুরাইশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ইসলামবিদ্বেষী আবু জাহেল। নবুওয়াতের ১৫ বছর পর সে ১ হাজার সৈন্য নিয়ে বদরের প্রান্তরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

এ ছিল এমন একটি যুদ্ধ, যেখানে উভয় পক্ষেই অনেক আত্মীয়-স্বজন ছিল। কিন্তু সত্য-মিথ্যার প্রশ্নে আজ তারা দুই দলে বিভক্ত। এক দল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত, আরেক দল ইসলামের চিহ্ন মুছে ফেলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কোনো পার্থিব স্বার্থ বা দ্বন্দ্ব নয়—শুধু সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যই তারা অস্ত্র ধরেছে।

যুদ্ধের পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন:
“হে আল্লাহ! আজ যদি এই ক্ষুদ্র বাহিনী পরাজিত হয়, তবে তোমার নাম কে তুলে ধরবে? আমি তোমার নামে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি।”

যুদ্ধের শুরুতেই এক এক করে ময়দানে এগিয়ে আসে কুরাইশদের তিন বীর—উতবা, তার ভাই শায়বা, এবং তার পুত্র ওয়ালিদ। মদিনার তিনজন আনসার সাহাবী তাদের মোকাবিলার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু উতবা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, “তোমরা তো মদিনার কৃষক, আমরা আমাদের সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী চাই।”

তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশে এগিয়ে আসেন তাঁর চাচা হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.), চাচাতো ভাই আলি ইবনে আবি তালিব (রা.) এবং উবাইদা ইবনে হারিছ (রা.)। হামজা (রা.) বলেন, “এবার কি তুমি তোমার সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছ?” উতবা উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, তুমি উপযুক্ত প্রতিপক্ষ।”

এরপর হামজা (রা.) শায়বাকে, আলি (রা.) ওয়ালিদকে হত্যা করেন। উবাইদা (রা.) উতবার সঙ্গে যুদ্ধ করে আহত হন। তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন হামজা (রা.) ও আলি (রা.) এবং উতবাকে হত্যা করেন।

তিন বীরের পতন দেখে কুরাইশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রবল সংঘর্ষ। মাত্র ৩১৩ জন মুসলিম যোদ্ধার বিপরীতে ছিল ১ হাজার কুরাইশ সেনা।

আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছিল অস্ত্রের শব্দ, আহত মানুষের আর্তনাদ ও উট-ঘোড়ার চিৎকারে।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইসলামের চিরশত্রু আবু জাহেল আহত হয়ে পড়ে যায় দুই কিশোর মুসলিমের হাতে। পরে তাকে হত্যা করেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। মক্কায় থাকার সময় তিনিই আবু জাহেলের হাতে বারবার অপমানিত হয়েছিলেন—তাকে ‘রাখাল’ বলে গালি দিত এবং মারধর করত। আজ সেই ‘রাখাল’-এর হাতেই আবু জাহেলের পরিণতি ঘটে।

সেদিন বদরের প্রান্তরে প্রতিশোধ নেন আরেক নির্যাতিত সাহাবী, হযরত বিলাল (রা.)। তিনি নিজ হাতে হত্যা করেন এক সময়ের তার নির্যাতক মনিব, উমাইয়াকে।

আবু জাহেলের মৃত্যুতে কুরাইশ বাহিনী ভেঙে পড়ে, তারা দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে কুরাইশদের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দি হয়। নিহতদের মধ্যে ছিল হিজরতের রাতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরাও। মুসলিমদের শহীদ হন মাত্র ১৪ জন—৬ জন মুহাজির এবং ৮ জন আনসার।

বদর ছিল একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ, কিন্তু এর প্রভাব ছিল বহু দূরপ্রসারী। কুরাইশরা মনে করত মুসলিমরা তাদের দয়ায় বেঁচে আছে, কিন্তু বদরের পর তারা বুঝে যায় যে মুসলিমরা একটি সংগঠিত ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

এই যুদ্ধের মাধ্যমে শুধু কুরাইশ নয়, পুরো আরব বুঝে যায়—ইসলাম এখন অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি।