খোলাফায়ে রাশেদীন ও চার খলিফার শাসন আমল (পর্ব-১)

আবু বকর (রা.)

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম উম্মাহর সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় ছিল—কে হবেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত, অর্থাৎ প্রথম খলীফা। এ সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া খুব জরুরি ছিল, কারণ দেরি হলে মুনাফিকরা সুযোগ নিতে পারত এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ইসলামকে দুর্বল করে দিতে পারত। সেই ঐক্য, যে ঐক্যের ভিত্তিতে নবীজী (সা.) তেইশ বছরের প্রচেষ্টায় ইসলামের ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন, তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

এ সময় মদীনার আনসারগণ “সাকীফা বনী সায়েদা” নামক স্থানে একত্র হন এবং নিজেদের মধ্য থেকেই একজন খলীফা মনোনয়নের প্রস্তাব দেন। তাঁদের যুক্তি ছিল—তাঁরাই ছিলেন যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং নিজেদের জান-মাল দিয়ে ইসলামকে রক্ষা করেছিলেন। তাই খেলাফতের দায়িত্বে তাঁরাই অধিকতর উপযুক্ত।

কিন্তু মুহাজিরগণ, যারা মক্কা থেকে হিজরত করে এসেছিলেন, তাঁরা এর বিরোধিতা করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল—তাঁরাই ইসলাম প্রচারের সূচনাকাল থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন এবং ইসলামের প্রথম বীজ বপন ও তার পরিচর্যার কাজ তাঁরাই করেছেন। ফলে খেলাফতের অধিকারে তাঁরাই অগ্রগণ্য।

এই বিতর্ক যখন তীব্র রূপ ধারণ করে, তখন হযরত আবু বকর (রাযি.)-কে সেখানে ডেকে আনা হয়। তিনি তখনো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র মরদেহের পাশে অবস্থান করছিলেন। তিনি সাকীফায় এসে অত্যন্ত ধীর, প্রাঞ্জল ও প্রজ্ঞাবান ভাষায় বক্তব্য দেন। তাঁর যুক্তি ও অভিজ্ঞতার কাছে আনসারগণ নম্রভাবে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেন। অবশেষে উপস্থিত সকলে সম্মত হন যে, হযরত আবু বকর (রা.)-ই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রকৃত স্থলাভিষিক্ত হবেন। এভাবেই মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.)-এর মনোনয়ন সম্পন্ন হয়।

খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকর (রা.)-এর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ধর্মত্যাগ ও বিদ্রোহ দমন করা। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে আরবের বহু অঞ্চলে অনেকে ইসলাম ত্যাগ করে আবার জাহেলিয়াতের দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। কেউ কেউ কর (যাকাত) দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এই কঠিন সময়ে হযরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত কঠোরতা ও সাহসিকতার সাথে এ সকল বিদ্রোহ দমন করেন এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখেন।

এই সমস্যা সমাধানের পর তিনি শুরু করেন ইসলামের আলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ। তিনি দুই মহাশক্তি—রোম ও পারস্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং মুসলিম বাহিনীকে বিজয়ের পথে পরিচালিত করেন।

পরবর্তীতে, ৭ই জুমাদাল উখরা, হিজরী ১৩ সনে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। পনেরো দিন ধরে অসুস্থ থাকার পর ২১শে জুমাদাল উখরা, বিকেলে তিনি ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে হযরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে দাফন করা হয়। তাঁর খেলাফতের মেয়াদ ছিল ২ বছর ৩ মাস ১০ দিন। হযরত আবু বকর (রা.)-এর নেতৃত্ব ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ প্রথম কঠিন সময় সফলভাবে অতিক্রম করে এবং ইসলামের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।

চলবে……..