খেলাফত লাভ
হযরত আবু বকর রা. অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করে যেতে চাইলেন। তাই পরামর্শক্রমে হযরত ওমর রা. কে-ই বাছাই করলেন। যদিও কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করেছিলেন তার কঠোর স্বভাবের কারণে। কিন্তু পরে সবাই তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অফাতের পর চারদিকে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়লে সবাই হযরত ওমর রা. কে খলিফা মনোনীত করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতাপ্রত্যাশী ছিলেন না। তাই তিনি সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর রা. এর হাতে বাইয়াত হলেন।
হযরত ওমর রা. সর্বপ্রথম আমিরুল মুমিনীন উপাধি লাভ করেন। খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে তিনি নমনীয় হয়ে পড়লেন। গোলামদের প্রতি এতই দয়ার্দ্র হলেন যে, আরবদের সমস্ত গোলাম আযাদ করে দিয়ে বললেন, আরবরা গোলাম হতে পারে না। চারদিকে ইনসাফ ছড়িয়ে পড়লো। তিনি প্রতি রাতে জনগণের অবস্থা জানার জন্য শহরে ঘুরে বেড়াতেন। এবং যথাসাধ্য সহযোগিতা করতেন। তার সময়ে ইনসাফ এত ব্যাপকতা লাভ করল যে, এক রাতে তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটি ঘরে শোনতে পেলেন, এক মা তার মেয়েকে বলছে, ওঠ, ভোর হয়ে এলো। দুধ দোহন করো এবং পানি মেশাও। মেয়ে বলল, মা, খলিফা তো দুধে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন। মা বলল, খলিফা কি এখন দেখবে? মেয়ে বলল, মা, আল্লাহ দেখবেন। পরে এই মেয়ের সাথে ওমর রা. পুত্র আমেরের বিবাহ দেন। তার গর্ভেই পরবর্তী সময়ে ওমর বিন আবদুল আজিজ রহ. জন্মগ্রহণ করেন, অর্থাৎ এই মেয়ে তার নানী। হযরত ওমর রা. এর খেলাফতের মেয়াদ ছিল দশ বছর। তার খেলাফতের আমলেই ইসলাম সবচেয়ে বেশি প্রচার-প্রসার লাভ করে। তিনি ইরাক, ইরান, মাদায়েন, মিসর, হিমস, বায়তুল মুকাদ্দাস এবং আলেকজন্দ্রিয়া বিজয় করে ইসলামের ঝাণ্ডা উত্তোলন করে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে দেন। তিনিই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজির ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সমস্ত ইসলামি সালতানাতের জায়গায় জায়গায় সেনাছাউনি বসান এবং মুসাফিরখানার ব্যবস্থা করেন। তিনি শেষ সময়ে ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবির তালিকা করে গিয়েছিলেন, পরামর্শক্রমে যাদের মধ্যে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত হবে ।
আল্লাহর ভয় ও রাসুলের ভালবাসা
হযরত ওমর রা. আল্লাহকে ছাড়া কাউকেই ভয় করতেন না। তিনি অধিকাংশ সময় আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। সারারাত নামাযে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিতেন। আল্লাহর ভয়ে নামাযে এমনভাবে দাঁড়াতেন, যেই কোনো দাস গুরুতর অপরাধের কারণে মুনিবের সামনে কম্পমান। এক রাতে তিনি তার পিঠে এক অনাহারী পরিবারের জন্য আটার বস্তা বহন করে নেওয়ার সময় তার গোলাম বললেন, আমাকে নিতে দিন। তিনি বললেন, কেয়ামতের দিন তুমি আমার বোঝা বহন করতে পারবে না।
আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হতে হবে। আমলের বিচার হবে। এই ভয়ে সবসময় তিনি তটস্থ থাকতেন। হাদিসে এসেছে, কেয়ামতের দিন হযরত আবু বকর রা. কে দিয়ে আল্লাহপাক বিচারের কাজ শুরু করবেন। তিনি জান্নাতের পয়গাম পেয়ে এসে হযরত ওমর রা. কে পাঠাবেন। হযরত ওমর ভয়ে সেখানেই কেঁদে ফেলবেন। অথচ তিনি ঐ দশজনের একজন, যারা দুনিয়াতে-ই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন ।
আল্লাহর প্রতি তার যেমন ছিল ভয় তেমনি ছিল ভালবাসা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরও ভালবাসা ছিল প্রগাঢ়। রাসুলের শানে বিন্দু পরিমাণ বেআদবি বা কটূক্তি তিনি সহ্য করতেন না। একবার এক মুসলমান ও ইহুদি কোনো বিষয়ে তর্ক করছিল। বিচারের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদীর পক্ষে রায় দিলেন। মুসলমান ভাবলো, ওমর তো কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর, তার কাছে যাই। তা হলে আমার প্রতি দয়া হবে। ইহুদির কোনো ভয় নেই। কারণ তার দাবিই সত্য। হযরত ওমর বললেন, আমার কাছে কেন? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও। তখন ইহুদি ঘটনা বলল। ওমর রা. বললেন, দাঁড়াও আসছি। এ কথা বলে ঘর থেকে তরবারি এনে সেই কথিত মুসলমানের শির মাথা থেকে আলাদা করে ফেললেন। আর বললেন, যে রাসুলের বিচার মানে না, ওমরের কাছে তার বিচার এটাই। পরবর্তী সময় খবর নিয়ে জানা গেলো ঐ ব্যক্তি মুনাফিক ছিল। এমনিভাবে তিনি সকল যুদ্ধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থেকেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অফাতের পর যখন চারদিকে ক্রন্দন রোল, তখন তিনি তরবারি হাতে বেরিয়ে পড়লেন এবং বললেন, যে বলবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতেকাল করেছে, তার গর্দান আলাদা করে ফেলবো। তার মাঝে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসা এতই প্রগাঢ় ছিল যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতেকাল তিনি মেনে নিতেই পারছিলেন না ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতেকালের পর বায়তুল মাকদিস বিজয় হলে তিনি একদিন সেখানে গমন করলেন। সেখানে হযরত বিলাল রা. এর কন্ঠে আযান শুনে তার মনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতি ভেসে ওঠে। ফলে কাঁদতে কাঁদতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। মৃত্যুর পরও যেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থাকতে পারেন তার জন্য হযরত আয়েশা রা. এর কাছে একাধিকবার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি প্রথমে নিষেধ করলেও শেষে হযরত ওমর সেই সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনের আশা পূরণে ছিলেন বদ্ধপরিকর। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আশা ছিল মুশরিকশূন্য আরব আর ইহুদিশূন্য মদিনা। তাই হযরত ওমর রা. তার খেলাফতকালে ইহুদিদেরকে মদিনা থেকে তাড়িয়ে দেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তার ভালবাসা সত্যিই অমর হয়ে থকবে।
ইলম ও জ্ঞান
হযরত ওমর রা. ছিলেন ইলমের সাগর। একজন রাসুলের যতমুখী জ্ঞান থাকা আবশ্যক, ঠিক ততখানিই হয়ত ছিল। যার ফলে তার শানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার পর নবী হলে ওমর হত। কিন্তু আমিই শেষ নবী। যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাষ্ট্র-পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে তার জ্ঞান অতুলনীয়। কুরআনের বহু আয়াতে তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে, তার কথার পক্ষে অবতীর্ণ হয়েছে। যখন মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মারা গেল তখন তার ছেলে, যিনি খাঁটি মুমিন ছিলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার পিতার জানাজা পড়ানোর জন্য অনুরোধ জানাল। ফলে দয়ার সাগর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অগ্রসর হোলেন। কিন্তু হযরত ওমর রা. জানতে পেরে দৌড়ে গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছন থেকে জামা টেনে ধরে বললেন, সে মুনাফিক, আপনি তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন না। তখন আয়াত নাযিল হয় ‘আপনি তাদের [মুনাফিক] কারো জানাজা পড়াবেন না এবং তাদের কবরের পাশেও দাঁড়াবেন না’ ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নামি স্বপ্ন দেখলাম, আমাকে একটি দুধের পেয়ালা দেওয়া হলো। আমি তা থেকে পান করলাম এবং অতিরিক্তটুকু ওমরকে দিলাম । তখন সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এর কী ব্যাখ্যা করবেন ইয়া রাসুলাল্লাহ। তিনি বললেন, ইলম ।
হযরত কাবিসা ইবনে জাবের রা. বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি আবু বকর থেকে বেশি দয়ার্দ্র এবং উত্তম কাউকে দেখিনি। আর কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে বেশি জ্ঞানী, দীনের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ফকিহ, আল্লাহর বিধান পালনে সবচেয়ে শক্ত এবং মানুষের হৃদয়ে সবচেয়ে ভীতি সঞ্চারকারী ওমর ছাড়া কাউকে দেখিনি। এবং ওসমান ইবনে আফ্ফান থেকে অধিক লজ্জাশীল কাউকে দেখিনি ।
দানশীলতা
হযরত ওমর রা. প্রচুর দান করতেন। তাবুক যুদ্ধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সবাইকে সম্পদ জমা করতে বললেন তখন তিনি তার সম্পদের অর্ধেক আল্লাহর রাস্তায় দান করলেন। খায়বর যুদ্ধে মুসলমানদের এত বেশি গনিমত অর্জন হয় যে, রীতিমত দরিদ্রজন ধনীতে পরিণত হয়। যাকাত গ্রহণের হকদার ব্যক্তি যাকাত প্রদান করতে থাকে । সেই সময়ে হযরত ওমর রা. তার প্রাপ্য সকল সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে দেন। আর এটাই আল্লাহর রাস্তায় সর্বপ্রথম ওয়াক্ফকৃত মাল। তার খেলাফতকালে এক দরিদ্র ব্যক্তি তাঁর কাছে অভাবের কথা বললেন। তিনি নিজের জামা খুলে তাকে দিয়ে দিলেন।
সন্তান-সন্ততি
হযরত ওমর রা. মোট পাঁচটি বিবাহ করেন। তবে একত্রে নয়। কাউকে ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে, কারো সাথে বনিবনা না হওয়ার কারণে তালাক প্রদান করেন। তিনি সর্বশেষ হযরত আলি রা. এর কন্যা হযরত উম্মে কুলসুম রা. কে বিবাহ করেন। তার দীর্ঘ জীবনের সাধ ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা । ফলে তিনি এই বিবাহে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন ।
হযরত ওমর রা. এর সন্তান-সন্ততির মধ্যে উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা রা. ও হযরত আবদুল্লাহ রা. অত্যধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। হযরত
ওমর রা. এর আর যে সব সন্তানের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন যায়েদ, মুজির এবং আবদুর রহমান রা.। হযরত যায়েদ পিতার জীবদ্দশায় ইনতেকাল করেন ।
ওমর (রা)-এর শাসন ব্যবস্থা
হযরত ওমর রা. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজেতাদের অন্যতমই ছিলেন না, সুযোগ্য প্রশাসক হিসেবেও তিনি অক্ষয় কীর্তি রেখে গিয়েছেন। হিট্টি বলেন, “ইসলামের ইতিহাসে হযরত ওমর রা. ছিলেন ধ্রুব নক্ষত্রের ন্যায় জাতির দিক নির্দেশক।” তিনি শুধু বিশাল সাম্রাজ্য জয়ই করেননি একটি সুদৃঢ় ও সুস্পষ্ট শাসন ব্যবস্থাও কায়েম করে গিয়েছেন। যা নিম্নে প্রদত্ত হলো,
১. শাসন ব্যবস্থার দুটি মূলনীতি : তার শাসন ব্যবস্থা প্রধানত দু’টি মূলনীতির উপর নির্ভরশীল। প্রথমত তিনি আরবীয়দের জাতীয়তা রক্ষা করার জন্য খায়বর হতে ইহুদিদেরকে এবং নাজরান হতে খ্রিষ্টানদেরকে উচ্ছেদ করেন। দ্বিতীয়ত: আরব আভিজাত্য সৃষ্টির মানসে তিনি আরব অনারবে মেলামেশা ও বিবাহ বন্ধন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
২. পরামর্শ সভা : আল্লামা শিবলী নোমানীর ভাষায় ওমর রা.-এর
বক্তব্য “পরামর্শ ব্যতীত কোন খিলাফত হতে পারে না।” হযরত ওমর রা.-এর শাসন ব্যবস্থা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল । ক. মজলিসুল – খাস ও খ, মজলিসুল-আম।
৩. পুলিশ বাহিনী : ওমর রা. জনশক্তি রক্ষা ও অপরাধ নিবারণ কল্পে দিওয়ানে এহদাস নামে পুলিশ বিভাগ খোলেন এবং এর বিভাগীয় প্রধানকে সাহেবুল এহদাস’ বলা হত ।
৪. গণতান্ত্রিক শাসন : ঐতিহাসিক মাওলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “Under Omar: he principle of democracy was carried :o a poin :o which i: will ye: :ake the world time :o a::ain.” গণতন্ত্রের ভিত্তিতে তিনি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন।
৫. রাজস্ব বিভাগ বা দিওয়ান : ভনক্রেমার ভাষায়, “সংক্ষেপে ওমরের দিওয়ানের ভিত্তিমূলে ইসলামের গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা গ্রথিত ছিল।”
৬. প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা : শানস ব্যবস্থার সুবিধার জন্য ওমর রা, সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৫টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রদেশের শাসন কর্তার উপাধি ছিল আমীর এবং জেলার শাসক ছিলেন ওয়ালী বা নায়েব ।
৭. সামরিক বিভাগ : ওমর রা. সেনাবাহিনীকে নিয়মিত ও অনিয়মিত দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। নিয়মিত সৈন্য বাহিনী সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকত ।
৮. বিচার বিভাগ : বিচার ব্যবস্থায় তিনি ছিলেন কঠোর। তিনি বিশ্বাস করতেন, Law is no respec:or of person বিচার বিভাগের সংস্কার সাধনে ইসলামের ইতিহাসে হযরত ওমর রা. এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। আদর্শ রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে খলিফা ওমর রা. বিচার বিভাগকে নির্বাহী শাসন ব্যবস্থা হতে পৃথক করে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তারই কঠোর নির্দেশে দিগ্বিজয়ী মহাবীর খালিদ সেনাপতির পদ হতে সামান্য সৈনিকের পদে নেমে আসেন। কথিত আছে যে, “ওমরের চাবুক অপরের তলোয়ার হতে ভয়ঙ্কর ছিল।” তার বিচার বিভাগ একদিকে যেমন অত্যন্ত সুক্ষ্ম ছিল, তেমনি অপর দিকে বিচার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর শুধু তার শাসন নীতির জন্যই নয় চরিত্র মাধুর্য, বিখ্যাত বিজেতা, এবং বৈপ্লবিক সংস্কারক হিসেবেও তিনি সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালে ইতিহাসের একজন আদর্শ রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন। বস্তুত তার মত ন্যায়পরায়ণ সত্যনিষ্ঠ এবং দায়িত্ব সম্পন্ন শাসক পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ধর্মানুরাগ কোমলতা, সংযম, বিচক্ষণতার তিনিই ছিলেন মহানবীর প্রতিচ্ছবি। তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলামের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শরীয়তের আইন প্রবর্তন করে রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থা সংস্কার সাধন করেন। মূলত তার শাসন প্রণালী এত ব্যাপক ও চমৎকার যে ইহা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা যায় না। ঐতিহাসিক ইমামুদ্দীন বলেন, “He was no : only a grea conqueror bu: classed for all time, among the best of rulers and nios : successful of the national leders.”
তাই ইসলামের মত এক সুন্দর আদর্শও মক্কার কোরাইশগণ গ্রহণ করেনি; বরং মুসলমানদের উপর শুরু হয় কোরাইশদের অমানুষিক অত্যাচার নির্যাতন। ফলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবিগণ মাতৃভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন।
ইনতেকাল
হযরত ওমর রা. তেষট্টি বছর বয়সে ২৩ হিজরি সনে শাহাদাত বরণ করেন। তার খেলাফতের বয়স ছিল দশ বছর পাঁচমাস এক দিন। তাকে ২৪ হিজরির মহররমের সকালে দাফন করা হয়। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন যিলহজ মাসের ২৬ তারিখ বুধবার সকালে। আক্রান্ত হওয়ার পর চতুর্থ দিন শাহাদাত বরণ করেন। তিনি শহীদ হবেন, তা পূর্ব থেকেই মহান প্রভুর দরবারে নির্ধারিত ছিল। তাই তো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আবু বকর, ওমর আর ওসমান রা. কে নিয়ে অহুদ- পাহাড়ে আরোহণ করলেন তখন অহুদ-পাহাড় কেঁপে উঠল। আর রাসুলের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, থাম, অহুদ-পাহাড় থাম। তুমি কি জান তোমার উপর কারা আছে? নবী, সিদ্দিক এবং শহীদ ।হযরত ওমর রা. শেষ হজ থেকে ফেরার পথে আবতা নামক স্থানে উট থামিয়ে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ, আমার বয়স অনেক হয়েছে। শক্তি কমে গেছে। তোমার বান্দাগণ দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়েছে। তুমি আমাকে তোমার কোলে তুলে নাও ।
তার শাহাদাতের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। ২৩ হিজরি সনের যিলহজ মাসের ২৬ তারিখ ফজরের নামাযের কাতার ঠিক করছিলেন হযরত ওমর রা. । ইকামতের পর তিনি নিয়ত বাধলেন এবং প্রথম রাকাতে সূরা ইউসুফ বা সূরা নাহল শুরু করলেন। এমনি সময় তিনি তাকবির বলে উঠলেন এবং বলতে লাগলেন, আমাকে হত্যা করেছে কিংবা বললেন, কুকুর আমাকে খেয়ে ফেললো। এ বলে তিনি হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. কে সামনে বাড়িয়ে দিলেন ইমামতির জন্য। ফলে তিনি সংক্ষেপে নামায শেষ করলেন। মুসল্লিরা হযরত ওমরের আওয়াজ না পেয়ে তাকবির দিতে লাগলো। এ দিকে একটি লোক কাতার ভেঙ্গে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। আর ডানে বামে যাকে পাচ্ছিল তাকেই আঘাত করছিল। এ অবস্থা দেখে একজন মুসলমান তার উপর চাদর নিক্ষেপ করলো। যখন সে দেখল ধরাপড়ে যাচ্ছে, তখনি সে তার ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করল। নামায শেষে হযরত ওমর রা. বললেন, এই ইবনে আব্বাস, দেখ তো কে আমাকে আঘাত করল? তখন তিনি গিয়ে দেখলেন হযরত মুগিরা ইবনে শুবা রা. এর গোলাম আবু লুলু। সে কামারের কাজ করত এবং অস্ত্র নির্মাণ করত। ঐ দিন সে মোট তেরজনকে আঘাত করেছিল। তাদের মধ্যে সাতজন শহীদ হয়েছেন। এরপর হযরত ওমর রা. তিনদিন পৃথিবীতে থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার দুই সাথী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রা. এর সাথে তাকে চিরদিনের জন্য শোয়ানো হয়।
চলবে………….
