আশারায় মুবাশশারাঃ সেই ১০ সৌভাগ্যবান সাহাবীর জীবনী (পর্ব-৮)

হযরত তালহা রা.

নাম ও বংশপরিচয়
নাম, তালহা। ডাকনাম আবু মুহাম্মদ ফাইয়্যায। খায়ের তাঁর উপাধি পিতার নাম ওবায়দুল্লাহ। মাতার নাম সোবাহ। হযরত তালহা রা. এর বংশধারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের সাথে সপ্তম পুরুষ মুররা ইবনে কাবের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। হযরত তালহা রা. এর পিতা ওবায়দুল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের পূর্বেই ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। অবশ্য হযরত তালহা রা. এর মাতা হযরত সোবাহ রা. ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বহুদিন জীবিত ছিলেন। আমিরুল মুমিনীন হযরত ওসমান গনি রা. বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়ার পর হযরত সোবাহ রা. ঘরের বাইরে চলে আসেন এবং হযরত তালহা রা. এর কাছে নিজের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন, ‘বাবা, তুমি তোমার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বিদ্রোহীদেরকে সরিয়ে দাও’ । তখন হযরত তালহা রা. এর বয়স ষাট বছর। এই হিসাবে বোঝা যায় তার মাতা অন্ততপক্ষে আশি বছরেরও বেশি জীবিত ছিলেন। রাসুলের মদিনায় হিজরতের চব্বিশ কি পঁচিশ বছর পূর্বে তালহা রা. জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবকাল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। অবশ্য ইতিহাস ঘেটে এতটুকু মজবুতভাবে বলা যায়- ছেলেবেলা থেকেই তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত হন। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে দেশ- বিদেশ সফর করার সুযোগ পান।

ইসলামের ছায়ায়
হযরত তালহা রা. এর বয়স যখন সতের কি আঠার বছর তখন একবার ব্যবসা উপলক্ষে বসরা গমন করেন। সেখানে জনৈক পাদ্রি তাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতপ্রাপ্তির সুসংবাদ জানায় ৷ কিন্তু জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত যে পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েছেন উক্ত পাদ্রির কথার বিশেষ কোনো প্রভাব তার মধ্যে পড়েনি। মক্কায় ফিরে আসার পর হযরত আবু বকর রা. এর নিঃস্বার্থ ওয়াজ-নসিহত দ্বারা হযরত তালহা রা. এর অন্তর থেকে ইসলাম সম্পর্কীয় সন্দেহ দূর হয়ে যায়। অতএব তিনি সিদ্দিকে আকবর রা. এর সাথে রাসুলের খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে তিনি সেই আটজন সাহাবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হন, যারা ইসলামের প্রথম যুগে ইসলাম ধর্মের সুশীতল ছায়ায় নিজেদের ঠিকানা গড়ে নেন।
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত তালহা ও অন্যসব মুসলমানের মত জালিম মুশরিকদের জুলুম-অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি। হযরত তালহা রা. এর আপন ভাই ওসমান ইবনে ওবায়দুল্লাহ বড় পাষাণ দিলের মানুষ ছিল । সে হযরত তালহা ও সিদ্দিকে আকবর রা. কে এক রশিতে বেঁধে নতুন ধর্ম ত্যাগ করার জন্য অনেক মারপিট করে। ইসলামের প্রতি তাদের এত গভীর প্রেম জন্মেছিল যার দরুন নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ত্যাগ করেননি।
মক্কায় হযরত জুবায়ের ইবনুল আওয়াম রা. এর সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ভ্রাতৃ-বন্ধন সৃষ্টি করে দেন। তিনি মক্কায় নীরব জীবনযাপন করেন এবং নিজের ব্যবসায় ব্যস্ত থাকেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত সিদ্দিকে আকবর রা. এর সাথে মদিনায় হিজরত করেন তখন হযরত তালহার বাণিজ্যকাফেলা শাম দেশে থেকে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার সাক্ষাত হয়। তিনি রাসুল ও সিদ্দিকে আকবরের খেদমতে শামদেশীয় কিছু মূল্যবান কাপড় হাদিয়ারূপে পেশ করে বললেন, মদিনাবাসিগণ দারুণ আগ্রহ নিয়ে আপনার অপেক্ষা করছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালবিলম্ব না করে মদিনার পথে পা বাড়ালেন। আর এদিকে হযরত তালহা রা. মক্কায় ফিরে ব্যবসা ছেড়ে সিদ্দিকি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় পৌছুলেন। তাদেরকে মেহমানরূপে সাদরে গ্রহণ করে নিলেন হযরত আদআদ ইবনে যিরারা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ও উবায় ইবনে কা’ব রা. এর মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জুড়ে দিলেন।
জিহাদে অংশগ্রহণ
একদিন জনৈক কাফের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অতর্কিতে তরবারি দ্বারা আক্রমণ চালাল। কিন্তু রাসুলের এই মাতোয়ারা প্রেমিক হাত বাড়িয়ে এই আক্রমণ প্রতিহত করেন। আঙুলগুলো এক এক করে সব কটি শহীদ হয়। উহ শব্দটিও বলেননি তিনি। উল্টো বেশ হয়েছে বলেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেন, যদি তুমি বেশ না বলে বিসমিল্লাহ বলতে তা হলে আসমানের ফেরেশতা তোমাকে উপরে তুলে নিয়ে যেত।
অহুদযুদ্ধে হযরত তালহা রা. বীরত্ব ও সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছেন পৃথিবীর কোনো জাতিই তার নমুনা দেখাতে পারেনি। তার সারা শরীর তীর-তলোয়ার ও নেজার আঘাতের চিহ্নে ভরপুর ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. তার শরীরে সত্তরেরও অধিক জখমের চিহ্ন গুনেছিলেন।
হযরত তালহা রা. এর বীরত্ব ও সাহসিকতায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে খায়ের উপাধিতে ভূষিত করেন। হযরত সিদ্দিকে আকবর রা. এর সামনে যখনই অহুদযুদ্ধের কথা আলোচনা হত, তখনই তিনি বলে উঠতেন, সেইদিন ছিল হযরত তালহার বৈশিষ্ট্যের দিন। হযরত ওমর ফারুক রা. তাকে অহুদওয়ালা বলতেন। হযরত তালহা রা. সেই বীরত্বের জন্য গর্ব করতেন এবং অত্যন্ত আগ্রহভরে অহুদযুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করতেন।
অহুদ যুদ্ধের পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত যত যুদ্ধ সংঘটিত হয় হযরত তালহা রা. স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সব কটিতে অংশগ্রহণ করেন। বাইয়াতে রিদওয়ানের সময় উপস্থিত থেকে তিনি বাইয়াত গ্রহণ করেন ।

মুসলিমজাহানে নৈরাজ্য সৃষ্টি

হযরত ওসমান গনি রা. বার বছর পর্যন্ত খলিফা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু শেষ ছয় বছর সমগ্র ইসলামি জাহান বিদ্রোহীদের দ্বারা কলুষিত হয়ে ওঠে। হযরত তালহা রা. খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত ওসমান গনি রা. এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে পরামর্শ দিলেন যে, বিদ্রোহের কারণ তদন্তের জন্য জায়গায় জায়গায় কমিটি গঠন করা হোক। এই পরামর্শ সাদরে গৃহীত হল । সেমতে হিজরি ৩৫ সনে হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা রা., হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রা., হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. কে দেশের বিভিন্ন স্থানে তদন্তের জন্য নিয়োগ করা হল। নিয়োগপ্রাপ্ত বুযুর্গগণ তদন্তের পর যাকিছু রিপোর্ট পেশ করেছিলেন তা কার্যকর হওয়ার পূর্বেই বিদ্রোহীরা হযরত ওসমান রা. এর ঘর অবরোধ করে ফেলে। হযরত তালহা রা. তখন বয়সের ভারে ক্লান্ত ছিলেন। তাই হযরত ওসমান রা. এর বিশেষ কোনো সাহায্য করতে পারেননি। তবে তিনি নিরপেক্ষ থেকে পরিস্থিতি অবগতির জন্য মাঝে মাঝে বিদ্রোহীদের সাথে মিলিত হন।

একবার তিনি বিদ্রোহীদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন এমন সময় হযরত ওসমান গনি রা. ঘরের ছাদে দাঁড়িয়ে বড় বড় সাহাবাগণের এক একজনের নাম ধরে ডাকলেন। তাদের মধ্যে তালহা রা.-ও ছিলেন। তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আমি আছি। তার পর হযরত ওসমান রা. জনসাধারণের প্রতি যেসব অনুগ্রহ করেছেন সেসবের স্বীকারোক্তি অনুসন্ধান করেন। হযরত তালহা রা. বিনাদ্বিধায় বিদ্রোহীদের সামনেই এসব কথা অকপটে স্বীকার করেন।

হযরত ওসমান রা. এর শাহাদাত

অবশেষে বিদ্রোহীদের অবরোধ যখন ভয়ানক আকার ধারণ করে তখন হযরত আলি রা. এবং হযরত জুবায়ের রা. এর মত হযরত তালহা রা.-ও নিজের ছেলে হযরত মুহাম্মদ ইবনে তালহা রা.-কে হযরত ওসমান গনি রা.-এর দেহরক্ষী নিযুক্ত করেন। বিদ্রোহীরা যখন আক্রমণ করে তখন হযরত মুহাম্মদ ইবনে তালহা রা. সর্বাধিক বীরত্বের সাথে তার মোকাবেলা করেন। পাহারাদাররা সংখ্যায় নগণ্য হলেও তারা বারবার বিদ্রোহীদের আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং তাদেরকে স্তব্ধ করে দেন। কিন্তু কিছুসংখ্যক পাষাণহৃদয় বিদ্রোহী ভিন্ন পথ দিয়ে ঢুকে সুপথের এই জ্বলন্ত বাতিটি চিরতরে নিভিয়ে দেয়। হযরত তালহা রা. এই দুঃসংবাদ শুনে বললেন, হযরত ওসমান রা. এর উপর আল্লাহ পাক রহমত বর্ষণ করুন। লোকেরা বলল, বিদ্রোহীরা এখন স্বীয় দুষ্কর্মে লজ্জিত। তিনি বললেন, আল্লাহ পাক তাদেরকে ধ্বংস করুন। তারপর তিনি সূরা ইয়াসিনের এই আয়াত পাঠ

করেন-

فَلا يَسْتَطِيعُونَ تَوْصِيَةٌ وَلَا إِلَى أَهْلِهِمْ يَرْجِعُونَ.

‘সুতরাং তারা ওসিয়ত করারও সুযোগ পাবে না এবং নিজ পরিবারের লোকদের নিকট ফিরে যেতেও পারবে না: (সূরা ইয়াসিন, আয়াত, ৫০)

হযরত ওসমান গনি রা. এর শাহাদাতের পর মিসরীয়রা খলিফাপদের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য হযরত আলি রা. কে বাধ্য করে। মসজিদে নববীতে বাইয়াতের জন্য জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। হযরত তালহা রা. যদিও নিজে খেলাফতের যোগ্য ছিলেন এরপরও তিনি হযরত আলি রা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন খলিফাতুল মুমিনীন হযরত ওসমান গনি রা. এর শাহাদাত ছিল একটা জঘন্য দুর্ঘটনা। ফলে সমগ্র দেশে বিশৃঙ্খলা এবং ফাসা’দ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এমনকি বিদ্রোহীদের প্রভাবে মদিনায়ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করতে থাকে। হযরত তালহা রা. চার মাস অপেক্ষা করেন; হয়তো শৃঙ্খলা ফিরে আসবে ।

চার মাসের মধ্যেও যখন খেলাফতের পক্ষ থেকে শৃঙ্খলা | প্রতিষ্ঠায় খুব একটা উন্নতি দেখা গেল না তখন তিনি নিরাশ হয়ে এর সংস্কার করে হযরত জুবায়ের রা.-সহ মদিনা থেকে মক্কায় গমন করেন। হযরত আয়েশা রা. পবিত্র হজ পালনার্থে মক্কায় গমন করেছিলেন এবং মদিনার পরিস্থিতি অবগত হয়ে তখন পর্যন্ত অবস্থান করছিলেন। তাই এই বুযুর্গদ্বয় সর্বপ্রথম হযরত মা আয়েশা রা. এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে মদিনার পরিস্থিতি বর্ণনা করেন এবং এই বিশৃঙ্খল অবস্থা সংস্কারের জন্য তাকে সম্মত করান। সামান্য আলোচনার পর হযরত মা আয়েশা রা. এই কাজের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। হযরত তালহা রা. এর মত অনুযায়ী প্রথমে বসরা যাওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হল। কারণ বসরায় হযরত তালহা রা. এর বহু সংখ্যক সমর্থক ছিল। তাই তারা ধারণা করেছিলেন সেখানে এই অভিযানের জন্য বিপুলসংখ্যক লোক একত্র করা যাবে। তা ছাড়া মিসরীয় বিদ্রোহীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বনু উমাইয়ার বহুলোক মদিনা ত্যাগ করে মক্কায় আশ্রয় নিয়েছিল। তারাও এই সংস্কারপ্রয়াসী দলে মিলিত হল । এভাবে একহাজার ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত এই দল বসরায় গমন করেন । বসরার কাছাকাছি পৌছুলে সেখানকার গভর্নর ওসমান ইবনে হানিফ তাদেরকে বাধা দিলেন। আপোষ-মীমাংসার চেষ্টা বৃথা গেল ৷

অবশেষে শক্তিপ্রয়োগ করে বসরা দখল করে নেওয়া হল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা ও হযরত তালহা রা. এর আগমন এবং যুদ্ধ- প্রস্তুতি ইত্যাদি সম্পর্কে হযরত আলি রা. অবগত ছিলেন। তাই তিনি মদিনা থেকে রওনা হয়ে জিকার নামক স্থানে আগমন করেন। এখান থেকে অন্তত নয় হাজার যোদ্ধা সংগ্রহ করে বসরার দিকে অগ্রসর হন।

হযরত তালহা ও হযরত জুবায়ের রা. তাদের আগমন এবং যোদ্ধাদের খবর শুনে সৈন্যদেরকে প্রস্তুত করেন। তারপর হিজরি ৩৬ সনের ১০ জমাদিউল উখরা তারিখে উভয় দল মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে আপোষ-মীমাংসার জন্য উভয় দলের নেতৃবৃন্দ জোর প্রচেষ্টা চালান। ইত্যবসরে হযরত আলি রা. হযরত জুবায়েরকে ডাকিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে হযরত জুবায়ের রা. মত পরিবর্তন করে এই যুদ্ধ থেকে বিরত হন। হযরত তালহা রা. তার ডান হাত হযরত জুবায়েরকে যুদ্ধ না করার সংকল্প নিতে দেখে তিনিও যুদ্ধ থেকে বিরত থাকলেন।

চলবে……….