আশারায় মুবাশশারাঃ সেই ১০ সৌভাগ্যবান সাহাবীর জীবনী (পর্ব-৫)

আল্লাহর ভয় ও রাসুলের মহব্বত

হযরত ওসমান রা. এর মাঝে আল্লাহ তায়ালার তাকওয়া ও ভয়-ভীতি ছিল সীমাহীন। আখেরাতের চিন্তায় থাকতেন সর্বদা চিন্তিত। তিনি কোনো কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে এত বেশি কাঁদতেন যে, তাঁর দাড়ি মোবারক ভিজে যেত। লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করত, আপনি কবরের কাছে এলে এত বেশি কাঁদেন কেন, অথচ অন্য সময় এত কাঁদেন না? তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কবর হল আখেরাতের প্রথম ঘাটি। যে এটা পার হতে পারবে সে-ই কামিয়াব। জানি না আমার প্রথম ঘাটি কেমন হবে; তাই এত কাঁদি।

একবার তিনি ক্রোধবশত এক গোলামের কান ধরে টান দেন। পরে তিনি অনুতপ্ত হন এবং প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গোলামকে বলেন, আমার কানও তুমি টেনে দাও। সে রাজি না হওয়ায় তিনি তাকে বাধ্য করেন। বলেন, জোড়ে টানো যেমন আমি টেনেছিলাম। দুনিয়ার প্রতিশোধ

পরকালের শাস্তি হতে হালকা। রাসুল সা. এর ভালবাসায় ছিল, তাঁর অন্তর ভরপুর। তিনি যেকোনো

সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করতে চেষ্টা করতেন। বাইয়াতে রিদওয়ানের দিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হাতকে ওসমানের হাত বলেছিলেন তিনি সে হাত দিয়ে কখনোই অমঙ্গল স্পর্শ করেননি। এতটাই ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন রাসুল সা. কে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুখ-শান্তি তাঁর একান্ত কাম্য ছিল। তাই তিনি সবসময় তাঁর পরিবারের লোকজনকে টাকা পয়সা হাদিয়া দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতেন। একবার এক সাহাবির দুই ছেলে এক ইহুদির বাগানে গেল। তারা বাগানে পড়ে থাকা দুটি খেজুর খেল। ফলে সেই ইহুদি তাদেরকে গাছের সাথে বেধে রাখল। অভাবের কারণে সাহাবি তাঁর জরিমানা দিয়ে ছেলেদেরকে ছাড়িয়ে আনতে পারছিল না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনে কাঁদতে লাগলেন। এ অবস্থা দেখে হযরত ওসমান রা. একশ খেজুর গাছবিশিষ্ট একটি বাগানের বিনিময়ে সেই খেজুর গাছটি ক্রয় করে তাদেরকে মুক্ত করে আনেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখের পানি মুছে দেন।

খেলাফত লাভ

হযরত ওমর রা. আততায়ীর দ্বারা আক্রান্ত হলে পরবর্তী খলিফা নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে অনুরোধ করলেন। তিনি বললেন, যদি আমি খলিফা নিযুক্ত করে যাই তা হলে আমার চেয়ে উত্তম ব্যক্তির পথই অনুসরণ করলাম [তথা হযরত আবু বকর রা.]। আর যদি নিযুক্ত করে না যাই তা হলেও আমার চেয়ে উত্তম ব্যক্তির পথ  অনুসরণ করলাম [তথা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম]। তারপর তিনি বললেন, যদি আবু ওবায়দা জীবিত থাকত তা হলে তাকেই খলিফা নিযুক্ত করে যেতাম। আমার রব আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আপনার নবীকে বলতে শুনেছি, সে এই উম্মতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। আর যদি আবু হুজায়ফার আযাদ-করা গোলাম সালেমও জীবিত থাকত তা হলে তাকে খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে যেতাম। আমার রব আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আপনার নবীকে বলতে শুনেছি, সালেম বড় আল্লাহ- প্রেমিক লোক। ফলে তিনি ছয়জনের এক জামাতের নাম উল্লেখ করে বললেন, এঁদের মধ্যেই পরামর্শক্রমে তোমরা একজনকে খলিফা নির্ধারণ করবে এবং তাকে সাহায্য করবে। ফলে হযরত ওসমান রা. এর হাতেই আল্লাহপাক খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, তোমার হাতে খেলাফতের দায়িত্ব এলে তা গ্ৰহণ কর এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাতে বহাল থেক। এ যেন রাসুলেরই পূর্ব-নির্ধারণ । তাই পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে শত বিপদ আসা সত্ত্বেও তিনি খেলাফতের দায়িত্ব ছাড়েননি ।

হযরত ওসমান রা. খলিফা হওয়ার পর সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, যা হযরত সিদ্দিকে আকবর রা. এর বেলায় হয়েছিল। ফলে তিনি তাঁর পথই অনুসরণ করলেন। হযরত ওমর রা. যেসমস্ত দেশ জয় করেছিলেন তারা বিদ্রোহ করে বসল। চারদিকে যখন বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল তখন হযরত ওসমান রা. সেগুলোকে কঠোর হাতে দমন করলেন। তিনি সবদিকেই সৈন্য প্রেরণ করলেন। হযরত অলিদ ইবনে আকাবা রা. আজারবাইজানের বিদ্রোহ দমন করেন। হযরত মুগিরা ইবনে শোবা রা. হামাদানবাসীর বিদ্রোহ দমন করেন। হযরত আবু মুসা আশআরি রা. ও হযরত বারা ইবনে আযেব রা. সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রায়বাসীদের বিদ্রোহ দমন করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার বিদ্রোহ খুব সহজেই হযরত আমর ইবনুল আস রা. দমন করেন। রোমানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে হযরত ওসমান রা. আট হাজার মুজাহিদের এক জামাত হযরত সালমান ইবনে রাবিআ রা. এর নেতৃত্বে হযরত মুয়াবিয়া রা. এর সাহায্যে প্রেরণ করেন। হযরত ওসমান রা. খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর ওই পথেই চলেছেন যে পথে তার দুই সাথী চলে গেছেন। তিনি বিভিন্ন দেশ জয় করে ইসলাম সম্প্রসারণের প্রতি আত্মনিয়োগ করেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি বিদ্রোহকবলিত ওইসব দেশকে দমন না করলে বিজিত এলাকাগুলো মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যেত।

শাহাদাতবরণ
হযরত ওসমান রা. এর শাহাদাতের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। বড় আফসোস হয় ওইসমস্ত লোকের ব্যাপারে, সাহাবাদের সাথে যারা বে- আদবি করেছিল ।
কিছু লোক তখন প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে বটে তবে গোপনে ইসলাম ধ্বংস করার পায়তারা করে। তাদের নেতৃত্বে ছিল আবদুল্লাহ ইবনে সাবা। মূলত সে ছিল ইহুদি। সে প্রথমে মিসর, পরে সমগ্র ইসলামি সালতানাত ভ্রমণ করে মানুষদেরকে তৃতীয় খলিফার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলতে থাকে। সে তার অপচেষ্টায় সফলও হয়। এমনকি তারা মদিনায় এসে মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। সেসময়ই শিয়া মতবাদের সৃষ্টি হয়। এই সূত্র ধরেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত নির্ভেজাল দীন ভেঙ্গে বহুদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে সত্য সর্বদাই ভারী থাকে। হযরত আলি রা. অস্ত্র হাতে তাদেরকে প্রতিহত করতে চাইলে হযরত ওসমান রা. বললেন, আমি কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করব না। উল্লেখ্য দুর্ভাগ্যবশত বিভ্রান্তির শিকার হয়ে কিছু মুসলমানও তাদের সাথে শরিক হয়েছিল ৷ ফলে আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ও তার দলবল এটাকে সুযোগ মনে করল এবং ষড়যন্ত্র আরো জোরেশোরে শুরু করল।
বিদ্রোহীরা তাঁকে তিনদিন আটক রাখল এবং এত কষ্ট দিল যে, তাঁকে তাঁর দান করা কূপের পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি। অবশেষে ১৮ যিলহজ ৩৫ হিজরি বিকেলে তারা দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করল। প্রথমে মুহাম্মদ বিন আবু বকর গিয়ে হযরত ওসমান রা. এর দাড়ি ধরল। তখন তিনি তাকে বললেন, মুহাম্মদ, তোমার পিতা থাকলে কি তুমি (8 এমনটা করতে? ফলে সে লজ্জা পেয়ে দাড়ি ছেড়ে দিল এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তখন অন্যরা তাঁর উপর ঝাপিয়ে পড়ে তরবারির আঘাতে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলল। হযরত ওসমান রা. এর স্ত্রী বাধা দিতে এলে তারা তাকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তারা শুধু তাকে হত্যাই করেনি; যাবার সময় ঘরের আসবাবপত্রও লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। শহীদ হওয়ার সময় তিনি সূরা বাকারা তিলাওয়াত করছিলেন।
পরিস্থিতি এত খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তিনি খেলাফতের দায়িত্ব ছাড়েননি। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক নিজের শাহাদাতের ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন, তোমাকে হত্যা করা হবে। আর তুমি থাকবে মজলুম। যেদিন তিনি শাহাদাতবরণ করেন সেদিন তিনি স্বপ্নে দেখলেন, রাসুল সা., আবু বকর রা. ও ওমর রা. তাঁকে বলছেন, তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নাও, আজ আমাদের সাথে ইফতার করবে। তিনি সেদিন রোজাদার ছিলেন। শাহাদাতের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

চলবে……….।